মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা ও আমাদের অবস্থান

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশের জাতীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে গুণগত ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা অত্যাবশ্যক। বর্তমান যুগে মানসম্মত শিক্ষা একটি অপরিহার্য চাহিদা। আর বিশেষভাবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য এটা সময়ের দাবি। মানসম্মত শিক্ষার অপরিহার্য উপাদান হলো আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষাক্রম, পর্যাপ্তসংখ্যক যোগ্য শিক্ষক, প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান সামগ্রী ও ভৌত কাঠামো, যথার্থ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, কার্যকর বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধান, উপযুক্ত মূল্যায়ন পদ্ধতি ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ইত্যাদি। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে হলে শুধু ভালো নম্বর বা গ্রেড পেলে হবে না, পাশাপাশি নৈতিকতা ও আত্মবিশ্বাসের সন্নিবেশ ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত পর্যায়ে নিয়ে যেতে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয় করে এবং প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও মানসম্মত করতে বিভিন্ন যুগোপযোগী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সর্বজনীন ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে রয়েছে বিভিন্ন বহুমুখী চ্যালেঞ্জ। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, প্রাথমিক শিক্ষার ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা অপরিহার্য। এ জন্য সরকার ২০১০ সালে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে এবং যা ২০১১ সাল থেকে চালু আছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সহায়তা করে। এতে শিশু প্রাথমিক শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। এ জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার শিক্ষাক্রমে শিশুকে শিক্ষার প্রতি ও বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করানোর বিষয়টিকে মূলত প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রাক-প্রাথমিকে শিশুর নির্ধারিত বয়স ৪+ বয়সী শিশু এবং সময়কাল এক বছর। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণিকক্ষ সুসজ্জিতকরণ, শিশুদের প্রয়োজনীয় খেলনার ব্যবস্থা ও শ্রেণিকক্ষের চারটি কর্নার যথাযথভাবে তৈরি করাসহ যেসব নীতিমালা রয়েছে, তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নীতিমালা অনুযায়ী প্রাক-প্রাথমিকে কোনো ধরনের লিখিত মূল্যায়নের বিধান রাখা হয়নি।

মূলত শিক্ষাদান বা শিখন-শেখানো পদ্ধতির কাজ হচ্ছে শিক্ষার্থী ও তার শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে যোগসূত্র তৈরির মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত শিখনফল অর্জনের চেষ্টা করা। শিখন-শেখানো কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদান হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষণীয় বিষয়বস্তু। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক ছিলেন শিক্ষাপ্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। কালের পরিক্রমায় আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা মুখ্য বা কেন্দ্রবিন্দু। আধুনিক শিক্ষণ পদ্ধতি মনোবৈজ্ঞানিক  নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে, যেখানে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মূর্ত থেকে বিমূর্ত বিষয়ে ধারণা লাভ, জানা থেকে অজানা বিষয়ে অগ্রসর হওয়া এবং বিভিন্ন শিক্ষণ পদ্ধতি ও কৌশলের ওপর। শিক্ষককেন্দ্রিক পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে বক্তৃতা পদ্ধতি, প্রদর্শন পদ্ধতি, আবৃত্তি পদ্ধতি, টিউটরিয়াল পদ্ধতি। আবার শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে আলোচনা পদ্ধতি, প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি, বিতর্ক, অভিনয় পদ্ধতি প্রভৃতি। কিন্তু আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষককেন্দ্রিক বক্তৃতা পদ্ধতির একচেটিয়া ব্যবহার লক্ষণীয়। ফলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা হয়ে গেছে অনেকাংশে মুখস্থনির্ভর ও ফলাফলকেন্দ্রিক।

ভালো নম্বর পেয়ে ভালো ফল করা সব শিক্ষার্থীরই উদ্দেশ্য। কিন্তু এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য না বুঝে মুখস্থ করা অবশ্যই একটি নেতিবাচক ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইতিহাস পড়ার সময় শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সাল, ঘটনা, নাম—এসব মুখস্থ করছে। ইতিহাস সম্পর্কে বইয়ে যা ছাপা আছে, শিক্ষক মোটামুটি সেগুলোই শিক্ষার্থীদের পড়ে শোনান, ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেন। অথচ এই বিষয়ের প্রতিটি অংশই দারুণভাবে অন্য বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে, তুলনা করে শিক্ষার্থীদের বোঝানো যায়। ঘটনাগুলোর ওপর নাটক বা অভিনয় করেও উপস্থাপন করা যায়। আবার অতীতের সঙ্গে বর্তমান প্রেক্ষাপটের মিল করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতর্কেরও আয়োজন করা যায়। ফলে সেই নাম, সাল বা ঘটনা মুখস্থ করার ওপরে নয়, তখন শিক্ষার্থীর মনোযোগ থাকবে ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা ও তুলনা করার ওপর।

খুব সাবলীলভাবেই মুখস্থ না করেও এসব তথ্য শিক্ষার্থীদের আরো বেশিদিন মনে থাকবে। এভাবেই শিক্ষার্থীরা মুখস্থ না করে জ্ঞান আত্মস্থ করবে। আমাদের শিক্ষকরাও যথেষ্ট চেষ্টা করেন বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে শিক্ষার্থীদের পড়াতে। কিন্তু শুধু শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর মধ্যে সীমিত থাকলে হবে না। শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রম থেকে শুরু করে পরীক্ষা মূল্যায়নেও পরিবর্তন আনতে হবে। সে ক্ষেত্রে জোর দিতে হবে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক বিভিন্ন শিক্ষণ পদ্ধতির ওপর, যার মধ্যে রয়েছে প্রশ্নোত্তর পদ্ধতি, যা একটি দ্বিমুখী প্রক্রিয়া। তবে উত্কৃষ্ট মানের প্রশ্ন তৈরি করতে হলে প্রয়োজন মেধাসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষক-শিক্ষিকার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পূর্বপ্রস্তুতি। তাই এ পদ্ধতির সফল বাস্তবায়ন করতে হলে দরকার যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং মানসম্মত প্রশিক্ষণ।

প্রাথমিক স্তরে শিশুদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা শিক্ষার মান। নিম্নমানের কারণে শিশুরা উপযু্ক্ত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং একপর্যায়ে ঝরে পড়ে। পূর্ণ যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাব, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, অপুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা—এসবই শিক্ষণপ্রক্রিয়ায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল, যেখানে শিক্ষার্থীদের স্কুলে নিয়ে আসা সম্ভব হয় না। এর অন্যতম কারণ দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও অপুষ্টি, যা উত্তরণে সরকার ‘জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯’-এর আওতায় রান্না করা খাবার, পুষ্টিকর বিস্কুট ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা নিয়েছে। শিক্ষার্থীদের স্কুলগামী করতে সরকার উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু রেখেছে।

এ ছাড়া বর্তমান সময়ে সরকার একজন শিক্ষার্থীকে তার শারীরিক, মানসিক, সামাজিক, গোত্রগত, জাতিগত ও ধর্মীয় পার্থক্য বিবেচনা না করে সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যালয়ের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে একীভূত শিক্ষা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে; যেখানে সব শিক্ষার্থীই শিখবে, সব শিক্ষার্থীই উপযুক্ত শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে, তাদের প্রয়োজন ও বয়স অনুযায়ী শিক্ষাক্রম পাবে এবং সবাই সহপাঠক্রমিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। এতে শারীরিক, মানসিক কিংবা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভাও বিকশিত হচ্ছে এবং তারাও বুঝতে পারছে তারা অন্যদের থেকে আলাদা নয়। তবে সব কিছুর সফল বাস্তবায়নে দরকার প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান।

প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, মানসম্মত ও যুগোপযোগী করতে হলে এর বিকেন্দ্রীকরণ এবং সচেতন জনগণের অংশ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এ জন্য দরকার এলাকাভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন। শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষকদের বেতনকাঠামো আকর্ষণীয় ও সন্তোষজনক করা, নিয়োগপ্রক্রিয়া সুষ্ঠু করা এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের বর্তমান ধারার সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি। আশার কথা হলো, সরকার এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং এর মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়নই আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে পৌঁছে দেবে মানসম্মত শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে।

লেখক : মো. শফিকুল ইসলাম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, রায়পুরা, নরসিংদী।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031719207763672