দেশের প্রচলিত প্রকাশনা ধারার বাইরে গিয়ে ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে যাত্রা শুরু করে উৎস প্রকাশন। দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছুরই শেকড়ে যাওয়ার লক্ষ্য ছিল উৎসের। সেরামানের গ্রন্থ প্রকাশনার জন্য ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি সম্মাননা লাভ করে উৎস প্রকাশন।
সম্প্রতি দৈনিক আমাদের বার্তার সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব বিষয় তুলে ধরেন উৎসের প্রকাশক মোস্তফা সেলিম। বাংলাদেশের প্রকাশনার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতও উঠে আসে তার আলোচনায়।
উৎসের যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে মোস্তফা সেলিম বলেন, গড়পড়তা বাণিজ্যের জন্য উৎস প্রকাশনের জন্ম হয় নি। আমরা দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, লোকসাহিত্য, বিলুপ্ত ভাষা, বর্ণমালা, মুক্তিযুদ্ধের শিকড় অনুসন্ধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত আমাদের হাজার খানেক বই প্রকাশ হয়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, দুষ্প্রাপ্য ও মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২০০। এগুলোর অন্যতম শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত।
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থের পুনঃমুদ্রণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে দুইখণ্ডের শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত গ্রন্থটির পূর্বাংশ বেরিয়ে ছিলো এবং ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে উত্তরাংশ প্রকাশ হয়। গ্রন্থ দুটি পুরোপুরি দুষ্প্রাপ্য হয়ে যায়। আমাদের পুনঃমুদ্রণের মাধ্যমে এক নতুন যাত্রার পথ উন্মোচন করি।
তিনি বলেন, খুলনার ইতিহাস, রংপুরের ইতিহাস, বিক্রমপুরের ইতিহাসসহ সিলেট অঞ্চলের উদ্ধারকৃত দুষ্প্রাপ্য ও দুর্লভ, গ্রন্থগুলো নিয়ে আমাদের কাজ করার সুযোগ হয়েছে।
আমরা লিপি সাহিত্য পুনরুজ্জীবনের মতো কাজও করেছি। চতুর্থ শতাব্দীতে বাংলা বর্ণমালার পাশাপাশি সিলেটি নাগরি লিপির প্রচলন হয়। বৃহত্তর বঙ্গের উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে এ লিপির সাহিত্য চর্চার চল ছিলো। সেটি পুনরুজ্জীবন করতেও কাজ করেছে উৎস।
নাগরি লিপি প্রসঙ্গে মোস্তফা সেলিম বলেন, সিলেটি নাগরি লিপি সাহিত্য পুনরুজ্জীবন করা এবং সেটিকে দেশ ও দেশের বাহিরে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ৫০ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া স্মৃতির বর্ণপরিচয়, বর্ণ, ইতিহাস ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে পুনর্জীবনের লক্ষ্যে ৩৬টি বই প্রকাশ করে উৎস।
মানহীন বই প্রসঙ্গে মোস্তফা সেলিম বলেন, আমাদের দেশের প্রথা হলো, জনপ্রিয় লেখকের পেছনে ছোটা, যার ফ্যান-ফলোয়ার বেশি তাঁদের পেছনে ছোটা। এসব লোকের বই বের হচ্ছে, ফ্যান-ফলোয়াররা আসছেন, বই কিনছেন এবং তাদের বই বেশ ভালোও বিক্রি হচ্ছে। আমাদের অবচেতন মনেই মানহীনদের জনপ্রিয় করে তুলছি।
বইয়ের দাম বৃদ্ধি, পাঠক কম এমন প্রসঙ্গে কথা বলার শুরুতে করোনার ওপর দায় দিতে চান না মোস্তফা সেলিম। তিনি বলেন, একটা সময় ছিলো একজন মানুষের সঙ্গে সংযোগের জন্য বিশেষ কোনো যোগ্যতার প্রয়োজন হতো, সে যোগ্যতা তার মধ্যে আত্মস্থ করতে হতো। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কুফল হলো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে আমরা হাস্যকর চরিত্রগুলোকে অবচেতন মনে সেলিব্রেটি তৈরি করে ফেলছি। নেটওয়ার্কিংয়ের ফলে একজন মানুষ সংসদ হওয়ার পূঁজি খুঁজে পাচ্ছেন। মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। বলা চলেই, আমরা একটি অশুভ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
প্রকাশক হওয়ার পেছনের প্রসঙ্গ টেনে মোস্তফা সেলিম বলেন, প্রকাশনায় আসা সম্পর্কে পরিবারের ধারণা ছিলো। পরিবার আমার ওপর নির্ভরশীল ছিলো না। শুরুতে অনেক প্রত্যাশা নিয়ে প্রকাশনায় যুক্ত হই। কিন্তু দীর্ঘ ২২ বছর পর যে এমন একটি ক্রান্তিকাল পার করতে হবে, এমন প্রস্তুতিও কখনো ছিলো না।
মোস্তফা সেলিম বলেন, আমরা এই সময়ে নেটওয়ার্কিংয়ে ব্যস্ত। যে লেখক ভাবছেন না, পড়ছেন না, তিনি মানসম্মত লেখক হতে পারেন না। আমরা প্রকাশক এবং বইপত্রের মানুষ হিসেবে আশাবাদী এ সংঘাত কেটে যাবে। একটা নির্দিষ্ট সময় অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রাখে সমাজকে চারপাশ, কিন্তু একদিন সে অন্ধকার অবশ্যই কেটে যাবে। এবং তখন মানুষ বইয়ের কাছে ফিরবে, সৃজনশীল মানুষ তৈরি হবে।
তিনি আরও বলেন, যখন একজন মানুষ বই বেশি পড়বে। তার মধ্যে সৃষ্টিশীলতার চৈতন্য, বোধগুলো জাগ্রত হবে। তখন লেখক তৈরি হবে। হয়তো কয়েক বছর এ অন্ধকারাচ্ছন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এভাবে দশকের পর দশক সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং ব্যবহার করে স্বল্প সময়ে বড় হওয়ার যে চিন্তা সেটি থাকবে না। কয়েক বছর কিংবা এক দুই বছর পর এমনিতেই কেটে যাবে।
এ প্রকাশক বলেন, গেল ১০ বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, আমার বিশ্বাস হয়তো সামনে আরো ৫-১০ বছর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এমন দাপট থাকবে। ধীরে ধীরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কাছে আমাদের জীবনকে যে বিপন্ন করে তুলেছি, সেটি উপলব্ধি হবে, তখন মানুষ সুস্থ ধারার কাছে ফিরবে। সুস্থ ধারার কাছে ফেরা মানে জ্ঞান চর্চার কাছে ফেরা, বইয়ের কাছে ফেরা। জ্ঞান চর্চার বিকল্প বই ছাড়া কিছু হতে পারে না। যুগের পর যুগ যেমন বই আছে, আমার বিশ্বাস পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বই থাকবে।