মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ করছে নতুন যে গবেষণা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আধুনিক মানুষের উৎপত্তি সম্পর্কে যে ঐতিহ্যবাহী তত্ত্ব প্রচলিত, সেটি এবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বহু বছর ধরে, একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সরা পূর্ব বা দক্ষিণ আফ্রিকার একক পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৯ সালে একদল বিজ্ঞানী দাবি করেছিলেন, আজকের আধুনিক মানুষের উৎপত্তি ঠিক কোন জায়গা থেকে হয়েছে সেটি তারা চিহ্নিত করেছেন।

সেই স্থানটি প্রাথমিকভাবে বোতসওয়ানা সেইসাথে নামিবিয়া এবং জিম্বাবুয়ের কিছু অংশ জুড়ে বলে ধারণা করেছিলেন গবেষকরা।

কিন্তু বর্তমান সময়ের শক্তিশালী কম্পিউটার মডেলিং এবং জেনেটিক ডেটা বিশ্লেষণে বেরিয়ে এসেছে ভিন্ন তথ্য।

কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে, আমরা মানুষ মূলত আফ্রিকার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা একাধিক পূর্বপুরুষের গোষ্ঠী থেকে এসেছি।

বলা হচ্ছে, আফ্রিকায় অন্তত দুটি গোষ্ঠী কোটি কোটি বছর ধরে সহাবস্থানে ছিল। সেখান থেকে মানুষ বংশবিস্তার করে পুরো মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

"আমরা জানি না এই দুটি গোষ্ঠী কোথায় থাকত, তবে তারা একে অপরের থেকে এতোটা দূরে ছিল যে দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সামান্য জিনগত পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়," ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের গবেষক ব্রেনা হেন এ কথা জানান।

ফসিলের অভাব
মানব প্রজাতি অন্তত তিন লাখ বছর আগে আফ্রিকা থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। এ পর্যন্ত মানুষের যতো প্রাচীন ফসিল উদ্ধার হয়েছে তারমধ্যে সবচেয়ে পুরনোটা ছিল তিন লাখ বছর আগের। সেই থেকেই মানুষের উৎপত্তির এই আনুমানিক হিসাব করা হয়েছে।

ধারণা করা হয় সেই ফসিলের সাথে আধুনিক মানুষের ইতিহাসের সংযোগ থাকতে পারে।

কিন্তু এখানে চ্যালেঞ্জের জায়গাটি হল: বিবর্তনের শুরু দিকের মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সের বেশি সংখ্যক ফসিল সংগ্রহ করা যায়নি।

যে কয়টি পাওয়া গিয়েছে সেগুলোর অবশিষ্টাংশ ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার মতো জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকায় কীভাবে মানব প্রজাতির উদ্ভব হল, কিভাবে তারা আফ্রিকার মহাদেশ জুড়ে এবং পরে পৃথিবীর বাকি অংশে ছড়িয়ে পড়ল - সে বিষয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।

নতুন গবেষণা ইঙ্গিত করে যে, আফ্রিকার একাধিক পূর্বপুরুষ গোষ্ঠী হোমো সেপিয়েন্সের উত্থানে অবদান রেখেছে, এই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জেনেটিক বৈশিষ্ট্যে সামান্য পার্থক্য ছিল বলে গবেষকরা জানতে পেরেছেন।[inside-a1]

তারাই বংশ বিস্তার করে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছেন এবং কয়েক হাজার বছর ধরে একে অপরের সাথে মিলেমিশে নানা ধরণের বৈচিত্র্য তৈরি করেছেন। অনেকটা নানা আকার ও রঙের মোজাইকের মতো।

২০১৮ সালে, জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের প্রত্নতত্ত্ববিদ এলিয়েনর স্কেরি এমন একটি গবেষণার সাথে যুক্ত ছিলেন যা সাম্প্রতিক গবেষণাকে কিছু ভিত্তি দিয়েছিল।

"আমরা প্রত্নতত্ত্ব, জীবাশ্ম, জেনেটিক এবং জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছি যে, আফ্রিকার একাধিক জনগোষ্ঠী থেকে মানুষ বিবর্তিত হয়েছে। আমরা এই মডেলটিকে আফ্রিকান মাল্টিরিজিওনালিজম বা প্যান-আফ্রিকান কাঠামোগত মডেল বলি," এমনটাই জানিয়েছেন স্কেরি।

"সেই সময়ে আমরা বলেছিলাম যে জেনেটিক মডেলগুলোকে একটি কাঠামোগত রূপ দেয়া প্রয়োজন এবং এজন্য আমরা জেনেটিসিস্টদের সেটি করার আহ্বান জানাই," বিশেষজ্ঞরা যোগ করেন।

হেন এবং তার সহকর্মীরা ঠিক তাই করেছে।

"জট বাধা ডালপালা"
“ছোট ছোট স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিয়ে গড়া এক বৈচিত্র্যময় বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে আমাদের শেকড় গাঁথা হয়েছে।” স্কেরি নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে এমন মন্তব্য করেন।

যদি বিষয়টিকে আমরা ছবি একে উপস্থাপন করি, তাহলে নকশাটি দেখতে অনেকটা "জট বাঁধা লতা বা ডালপালার মতো দেখাবে।” ট্রি অফ লাইফ অর্থাৎ সাজানো কোন বিন্যাস মনে হবে না।

এই জড়িয়ে থাকা লতাগুলোকে শুধুমাত্র জিনগত পার্থক্য দিয়ে আলাদা করা সম্ভব এবং এটি বিবর্তনের ধারণাকে একটি নতুন রূপ দিয়েছে। যাকে গবেষকরা ব্যাখ্যা করেছেন “জড়িয়ে থাকা লতাপাতার কাঠামো” হিসেবে।

এই উপসংহারে পৌঁছাতে হেন এবং তার সহকর্মীরা একটি শক্তিশালী কম্পিউটার মডেল ব্যবহার করেন।

"গবেষক দলটি এজন্য একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করেছেন যা তৈরি করেছেন কানাডার মন্ট্রিয়লের ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-লেখক সাইমন গ্রেভেল।

এই সফটওয়্যারটি মডেলিংয়ের কাজে জন্য প্রয়োজনীয় বিশাল কম্পিউটিং শক্তিকে সমন্বয় করতে পারে," নেচার জার্নালের রিপোর্টে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে৷

তারা পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকার বাসিন্দা সেইসঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার নামা জনগোষ্ঠী মিলিয়ে মোট ২৯০ জনের জিনোম সিকোয়েন্সিং উপাত্ত সংগ্রহ করেন।

তারপর তারা আফ্রিকায় বিদ্যমান জনগোষ্ঠীকে নিয়ে গবেষণা করেন। বিভিন্ন সময়কালে এই মানুষগুলো কেমন ছিলেন সেই দৃশ্যপট তৈরি করেন। এরমধ্যে কোনটি আজকের মানব প্রজাতির মধ্যে পাওয়া ডিএনএ-এর বৈচিত্র্যের সাথে মিলে যায় সেটা দেখার চেষ্টা করেছেন গবেষকরা।

"এই জিনোমিক তথ্য, এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে জিনের ঐতিহাসিক গতিবিধি ধরতে এবং বুঝতে গবেষকদের সাহায্য করেছে" এমন তথ্য জানিয়েছে নেচার জার্নাল।

গবেষণায় উঠে এসেছে যে আমরা যারা এখন বেঁচে আছি - তারা সবাই প্রায় ১০ লাখ বছর আগে আফ্রিকায় থাকা অন্তত দুটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিজেদের পূর্বসূরিদের খুঁজে পাবো।

সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে অন্তত দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীর সন্ধান পাবো - যারা লাখ লাখ বছর আগে থেকে আফ্রিকায় বাস করে আসছে।

উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিসিস্ট অ্যারন রাগসডেল এবং প্রধান লেখক বলেছেন, "এতদিন ধারণা ছিল সব মানুষ একই পূর্বপুরুষ থেকে এসেছে, কিন্তু আমাদের অতীত ইতিহাসের গভীরে গেলে দেখা যাবে বিষয়টি আরও জটিল। মানব প্রজাতির একক স্থান বা একক গোষ্ঠী থেকে বিবর্তিত হওয়ার ধারণাটি জটিল।"

৯১ জন ইউরোপীয়ের জিনোম উপাত্ত পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে যে তাদের মধ্যে উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগ এবং নিয়ান্ডারথাল প্রজাতির প্রভাব রয়েছে কিনা।

নিয়ান্ডারথাল মানবজাতির সন্ধান ইউরোপ ‌এবং এশিয়ার মধ্য ও পশ্চিম অঞ্চলজুড়ে পাওয়া গিয়েছিল এবং প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে তারা বিলুপ্ত হয়ে যায়।

ভবিষ্যতের ভিত্তি
স্কেরি পরিশেষে বলেছেন যে এই গবেষণার গুরুত্ব শুধুমাত্র মানব বিবর্তনের নতুন মডেলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এটি জেনেটিক দৃষ্টিকোণ থেকে একাধিক উৎস থেকে বিবর্তনের তত্ত্বকে সমর্থন করে।

আফ্রিকায় গত ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার বছর ধরে যারা বসবাস করছেন তাদের ডিএনএ নিয়ে গবেষণা হয়েছে। নতুন এই গবেষণা অন্যান্য জেনেটিক গবেষণার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে বলে বলা হচ্ছে।

“ইতিমধ্যেই মানব প্রজাতির গভীরে থাকা ডিএনএ কাঠামো পর্যবেক্ষণ করেছেন গবেষকরা,”  বলেন স্কেরি ৷

"এটি খুব দারুণ খবর যে গবেষণার সব ফলাফল আমাদের মডেলকে সফল হতে সাহায্য করেছে এবং মানব প্রজাতি আফ্রিকার একটি একক অঞ্চল বা একক জনসংখ্যা থেকে বিবর্তিত হয়েছে বলে যে পুরনো ধারণা প্রচলিত রয়েছে সেই ধারণার কফিনে আরেকটি পেরেক ঠুকে দিয়েছে।"

সাম্প্রতিক এই গবেষণার ফলাফল সঠিক কিনা তা স্পষ্টভাবে বলা যাবে না।

মানব প্রজাতির উদ্ভব নিয়ে জটিলতা অব্যাহত থাকবে এবং এ নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধান যে চলতেই থাকবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

পরবর্তী গবেষণাগুলোকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তি।

সূত্র : বিবিসি


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041399002075195