একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। ভাষা শহীদদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এ দিনটি জাতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং দিনটি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও স্বীকৃত। ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন, মানুষের মায়ের ভাষা এবং কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে যা বিশ্বের সকল দেশ গভীর শ্রদ্ধা ও যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে উদযাপন করে থাকে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্য জীবন দিতে হয় এইরূপ ঘটনা ছিল পৃথিবীতে বিরল।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্থান ও ভারতের জন্ম হয়। নতুন উদ্দীপনায় দুটি রাষ্ট্র স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলতে শুরু করলেও ভাষা নিয়ে দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরপরই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতারা এবং উর্দুভাষী বুদ্ধিজীবীরা বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে দাবি ওঠে, বাংলাকেও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার বাংলা ভাষার এ দাবিকে সর্ম্পূণরুপে উপেক্ষা করতে শুরু করে। এতে বাংলার ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী মহল ক্ষুব্ধ হন এবং ভাষার ব্যাপারে তাঁরা একটি চূড়ান্ত দাবিনামা প্রস্তুত করেন। দাবিটি ছিল-পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষা ও সরকারি কার্যাদি পরিচালনার মাধ্যম হবে বাংলা আর কেন্দ্রীয় সরকার পর্যায়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু।
উল্লেখ্য যে, ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় বাংলার অধিবাসীরা বাংলা ভাষাকে তাঁদের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। তাছাড়া, ভারতীয় সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ২৩টি সরকারি ভাষার মধ্যে বাংলা ছিল অন্যতম। বাংলা ভাষা ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্যের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতবর্ষ বিভাগের পর ৪ কোটি ৪০ লাখ বাংলা ভাষাভাষি মানুষ পূর্ববাংলার অর্ন্তভুক্ত হয়। উনিশ শতকের শেষভাগে মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হতে শুরু করে। স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারতের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা নিয়ে গঠিত বঙ্গ অঞ্চলের বাঙালি অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা ভাষা। ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণাংশ, আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসী বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ঝাড়খন্ড, বিহার, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা এবং আসামের করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের অধিবাসিদের একটি অংশের মাতৃভাষা বাংলা। বস্তুত, বাংলা ভাষা প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরানো এবং দেশ-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে বাঙালি সমাজে বহুল প্রচলিত শব্দ ও সংস্কৃতি নিয়ে গঠিত।
বাংলা ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রদেশিক ভাষা করার জন্য সর্বপ্রথম প্রস্তাব করে ‘গণ আজাদী লীগ’। এই বিষয়ে তৎকালীন সংবাদপত্রগুলো বেশকিছু গবেষণা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে সকল নিবন্ধের সারকথা ছিল বাংলাকে প্রদেশিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে। পাকিস্থান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়, মুদ্রা ও ডাকটিকেট থেকে বাংলা ভাষা মুছে ফেলা হয়। এতে পূর্ব পাকিস্থানের জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় এবং বাঙালি ছাত্রদের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে সরকারি ভাষা করার দাবীতে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে জমায়েত হয়ে মিছিল ও সমাবেশের করে। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করে।
বাংলা ভাষার অবস্থান নিয়ে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি গণপরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার দাবি জানিয়ে একটি সংশোধনী আনেন। বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল হয়ে যায়। গণপরিষদের ঘটনায় প্রথম বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশ শেষে ১১ই মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গণপরিষদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, বর্ধমান হাউস, হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে অফিস বর্জনের জন্যে সবাইকে চাপ দিতে থাকে, ফলে বিভিন্ন স্থানে তাঁদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয় এবং অনেকেই গ্রেফতার হন। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ্ মো. নাসিরুদ্দীন, নরুল ইসলাম প্রমুখ। অতপর ধর্মঘট ও তীব্র আন্দোলনের মুখে ১৫ মার্চেই বন্দিদের মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কায়দে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহ্ ভাষা আন্দোলনকে মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করেন। সেখানে তিনি উর্দুই হবে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দেন। তিনি ২৪শে মার্চ কার্জন হলে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা পুনঃব্যক্ত করেন। ছাত্ররা এই ঘোষণার তাৎক্ষনিক প্রতিবাদ করেন। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দীন করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। তিনি পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলেন যে, প্রদেশের সরকারি কাজকর্মে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে তা প্রদেশের জনগণই ঠিক করবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে কেবলই উর্দু। সঙ্গে সঙ্গে এর তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয় এবং ‘রাষ্টভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে ছাত্ররা বিক্ষোভ শুরু করেন। বাংলা ভাষা সর্বস্তরে প্রচার ও প্রচলন করার জন্য সারা দেশে সংগ্রাম শুরু হয়। ভাষা বিকাশের, ভাষা সম্প্রসারণের, ভাষার সৌন্দর্য বৃদ্ধির এবং ভাষা বিস্তরণের পরিকল্পনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন জেলা এবং বিভাগীয় শহরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তৈরি হয় ব্যারিকেড। প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়েই এ দেশের সাধারণ ও নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষ, কষ্ট-দুঃখ বুকে নিয়ে তাঁদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট পালিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ‘সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সময় সরকার আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব পেশ করে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের মার্চে এ নিয়ে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলন শুরু হয় এবং ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি তার চরম প্রকাশ ঘটে। পরিষদ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে। ঘটনার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ২০ ফেব্রুয়ারি এক মাসের জন্য সকল রকমের সভা, সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ঐদিন রাতেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে এবং ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতামতকে বিবেচনা করার জন্য পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের আহ্বান জানায়। আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাঁধা দেয়। এই ঘটনায় পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে ফলে ঘটনাস্থলেই আবুল বরকত, রফিক উদ্দিন আহমদ, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। তাঁদের প্রাণদান ছিল মাতৃভাষায় কথা বলাসহ অধিকার আদায়, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। পুলিশের গুলির খবর জানতে পেরে গণপরিষদে মনোরঞ্জন ধর, বসন্তকুমার দাস, শামসুদ্দিন আহমেদ এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তসহ প্রমুখ মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনকে আহত ছাত্রদের দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার এবং শোক প্রদর্শনের জন্য অধিবেশন স্থগিত করার অনুরোধ করেন। কিন্তু নুরুল আমিন অধিবেশনে বাংলা ভাষার বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন। ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখ সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। বেলা ১১টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ তাঁদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই গুলিবর্ষণে শহীদ হন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, অহিদুল্লাহ এবং আব্দুল আউয়াল এবং অনেকেই গুরুতর আহত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা শহিদ মিনার তৈরির কাজ শুরু করে এবং ২৪ তারিখ ভোরে শেষ করে। এই অস্থায়ী শহিদ মিনারের জায়গায় ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি শহিদ মিনার তৈরি হয়।
ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্থানের কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা ভাষাকে পাকিস্থানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় ভাষা ও সরকারি ভাষা হল বাংলা। পাকিস্তানের করাচী শহরের দ্বিতীয় সরকারি ভাষারূপে বাংলাকে গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলা ভাষা দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় বাইশ কোটি মানুষের স্থানিয় ভাষা এবং পৃথিবীর মোট ৩৪ কোটি মানুষের ভাষা হওয়ায়, এই ভাষা বিশ্বের সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাগুলির মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছে। নোবেলজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুইটি বাংলা কবিতা ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত। শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও এই ভাষাতে রচিত এবং তা থেকেই দক্ষিণ এশিয়ায় এই ভাষার গুরুত্ব বোঝা যায়।
যে সব মানবতাবাদী রাজনীতিবিদ এ দেশকে নিয়ে ভেবেছেন তাঁদের জীবনের শ্রম, কষ্ট ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমাদের আজকের বাংলাদেশ। বিভিন্ন বিভাজনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের স্বৈরশাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবি পেশ করেন। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে তিনি উচ্চারণ করেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম উচ্চারণ-
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এই ঘোষণার পর পরই বাঙালিদের মধ্যে নেমে আসে স্বৈরশাসকের দমন-পীড়নের পরাকাষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুকে ২৫ মার্চ ১৯৭১ বন্দি করে নিয়ে যায় পাকিস্থানে। বাংলাদেশে শুরু হয় সশস্ত্র সংগ্রাম। মেহেরপুরের মুজিবনগরে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ এপ্রিল গঠিত প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘ নয় মাস স্থায়ী হয় এবং ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশ অর্জন করে কষ্টের স্বাধীনতা, লাল-সবুজের পতাকা। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ আজ সত্য এবং শাশ্বতরূপে প্রতিষ্ঠিত একটি দেশ।
ব্রিটিশ থেকে পাকিস্তান হলো, পাকিস্তান থেকে ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭১ এর আন্দোলন-সংগ্রাম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। যে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এ দেশের মানুষ এক কাতারে এসে দাঁড়াতে পেরেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল নায়ক ও স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব ভাষা-আন্দোলনেরই সুদূর প্রসারী ফল’। আজন্ম মাতৃভাষা প্রেমী এই মহান নেতা ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্ব, পরবর্তী সময় আইন সভার সদস্য এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছেন। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাভাষা সম্প্রসারণে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। বিশ্বসভায় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এটাই ছিল প্রথম সফল উদ্যোগ। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের সংবিধানে তিনি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেন। এটাই ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম বাংলা ভাষায় প্রণীত সংবিধান। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে জন্য কাজ করে গেছেন।
এ দেশে যুগে যুগে অসংখ্য ক্ষণজন্মা মনীষীর জন্ম হয়েছে যেমন- শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইত্যাদি। এ দেশ রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ, জসীমউদ্দিন প্রমুখ সফল মানুষের সোনার দেশ। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে কানাডায় বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে । ফলে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। এই ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখা সকল বাংলাদেশি নাগরিকের পবিত্র কর্তব্য ও দায়িত্ব। এই ভাষার আধুনিকায়ন এবং সফল বাস্তবায়ন এর মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন করাই হউক আমাদের সকলের দৃঢ় অঙ্গীকার।
লেখক : পরিচালক (প্রশিক্ষণ ও বাস্তবায়ন), জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), শিক্ষা মন্ত্রণালয়।