ইলিশ শিকারে বেপরোয়া জেলেরা এবার নয়া কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। ধরা পড়লে সাজা এড়াতে ও মুচলেকার মতো সহজ শর্তে মুক্তির কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের।
সংশ্লিষ্টরা জানান,সুস্বাদু ইলিশের জন্য পরিচিত তেঁতুলিয়াসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে গত তিন-চার দিন থেকে ইলিশ আসতে শুরু করেছে। প্রশাসনের অভিযানকে তেমন পাত্তা না দিয়ে জেলেরা সুযোগ মতো জাল ফেলছে ইলিশ শিকার করতে। এই কাজে তারা ব্যবহার করছে শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের, যাতে প্রশাসনের হাতে ধরা পড়লে অপ্রাপ্ত বয়স্ক হিসেবে জেল হাজতের মতো সাজা এড়িয়ে সহজ শর্তে মুক্তি পেতে পারে। বেআইনী কাজে শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থীদের এভাবে ব্যবহার করায় অনেকেই উদ্বিগ্ন।
গত ৯ অক্টোবর জেলার বাউফলের কালাইয়া বন্দরের নৌ-ফাঁড়ির পুলিশ তেঁতুলিয়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে অভিযান চালিয়ে ৫টি নৌকা, ১০ হাজার মিটার জাল ও ৬০ কেজি ইলিশসহ ভোলা ও বাউফলের ২২জনকে আটক করে। এদের মধ্যে ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হলেও কেবল অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু ও শিক্ষার্থী বিবেচনায় অভিভাবকদের মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয় ১২ জনকে। এর আগে নিষেধাজ্ঞার ৭ম দিন ১১ অক্টোবর তেঁতুলিয়ায় দুটি ইঞ্জিনচালিত মাছ ধরার ট্রলার ও ৪শ’কেজি ইলিশ মাছসহ আটক করা হয় ৫ জনকে। ওই দিনও বাবুল সাজ্জাল (৪২) ও জাকির সাজ্জাল (৩২) নামে দুইজনকে মামলা দিয়ে থানায় হস্তান্তর করা হলেও অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় মুচলেকায় ছেড়ে দেয়া হয় অপর তিনজনকে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাউফলের ধানদী গ্রামের কয়েকজন জেলে দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, উপজেলার তেঁতুলিয়া নদী সংলগ্ন গ্রামের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইমরান, রাব্বি, ইমরান, রিফাত, জিসান, জাহীদুল, পাশের চন্দ্রদ্বীপের সোহেল, তরিকুলসহ অনেক শিক্ষার্থী নিতান্তই পরিবারের প্রয়োজনে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন সময় ইলিশ শিকারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ে। জেলে-শ্রমিক ওই সব শিক্ষার্থীদের মতো নদী পাড়ের ছয়হিস্যা, তাঁতেরকাঠি, তালতলী, বড়ডালিমা, কালাইয়া, শৌলা বগির খাল, চরকালাইয়া, ধুলিয়া, মঠবাড়িয়া, মমিনপুর, চন্দ্রদ্বীপের চর রায়সাহেব, চর ওয়াডেল, বাদাতলী এলাকার জেলে পরিবারের বিপুল সংখ্যক শিশু-কিশোর ও শিক্ষার্থী জড়িয়ে আছে ইলিশ শিকারের মতো মাছ ধরার কাজে। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় এসময় নদীতে ধরা পড়ে প্রচুর ইলিশ। তাই এসব শিক্ষার্থীর কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞায় ইলিশ শিকারের অপরাধে জেল-জরিমানার বিষয়টি না বুঝলেও অভিভাবকদের সঙ্গে নদীতে নৌকা-জাল নিয়ে বের হয় ইলিশ শিকারে। অভিভাবক জেলেদের কৌশলে ব্যবহৃত হয় তারা।
আবার কখনো নিতান্ত আগ্রহ থেকেও নদীতে যায় তারা। অশিক্ষিত অভিভাবক জেলেরাও তাদের স্কুল-মাদরাসা পড়ুয়া এসব ছেলেদের ভবিষ্যৎ না ভেবেই এ সময় ইলিশ শিকারের কাজে লাগাচ্ছেন। কথা হয় অবরোধে ইলিশ শিকারে জড়িত রাব্বি নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে। দূর থেকে প্রশাসনের অভিযানে বের হওয়া ট্রলার ছুটে আসতে দেখে নৌকা ফেলে দ্রুত সটকে পড়ছিল রাব্বি। প্রথমে তেঁতুলিয়া নদীর তীর লাগোয়া ধান ক্ষেতের ভেতর পালাতে গিয়েও আবার ফিরে আসে সে নদীতে পেতে রাখা জাল ও জালের ফাঁসে আটকানো সম্ভাব্য ডিমওয়ালা ইলিশের নেশায়।
উঁকি মেরে নজর রাখছিল সে দূর থেকে আসতে থাকা অভিযানের ট্রলারের দিকে; একই সঙ্গে পায়ে মাড়িয়ে রাখছিল সে নদীতে পেতে রাখা অতিরিক্ত ভাড়ের কাঠিতে নদীর পানিতে ডুবন্ত ভাসানবিহীন কারেন্ট জালের আঁচলের রশি। নিষেধাজ্ঞায় ইলিশ শিকারের বিষয়ে রাব্বি দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ‘নদীতে এহোন মাছ পাওন যায়। বাপ নাই। এতিম। এহোন মাছ না ধরলে মায়রে লইয়া কি কইরগ্যা খামু। ধরা পড়লে জাল পোড়াইয়া দেবে দেউক। আমি ছোড মানুষ, জেল তো দেবে না। দস্তগত রাইখ্যা নাকি ছোডগোরে ছাইড়্যা দেয়।’দশমিনা উপজেলার হাজিরহাট এলাকার কয়েকজন জানান,অভিযানে এসে বাজারের দোকানে বসে কর্তাব্যক্তিরা চা-নাস্তা খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অথচ অদূরেই নদীতে জেলেরা জাল পেতে শিকার করে মা-ইলিশ। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে ও প্রশাসনের অভিযান পরিচালনার অবসরের সুযোগ বুঝে বেপরোয়া জেলেরা নদীতে শিকার করে ইলিশ। অনেকটাই ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলে সেখানকার নদীতে। আবার সাইজে ছোট বড় হলেও এ সময় জেলেদের শিকার করা অধিকাংশ মাছের পেটেই রয়েছে ডিম। মা-ইলিশ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় পরিচালিত অভিযানে কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে লেখালেখির বিষয়টিও জানান তারা।
এদিকে ইলিশ শিকারে কৌশল হিসেবে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার দুঃখজনক এবং অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য বিভাগের সংশ্লিষ্টরা। গত রোববার পর্যন্ত নৌকা, জাল ও ইলিশসহ ৩৬জনের মতো আটকের কথা জানিয়েছেন উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মাহবুব আলম তালুকদার ঝান্টা।