মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবরে থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের অপারেশন ১০২৭ শুরু হওয়ার পর থেকে উভয় পক্ষের মধ্যেকার সংঘর্ষের তীব্রতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই সংঘর্ষের ফলে হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং মিয়ানমারের পুরো সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্য রুটগুলো বিভিন্ন সময় হাতবদল হওয়ার কারণে মিয়ানমারের সঙ্গে দেশগুলোর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী সংঘর্ষের ফলে অনেক জায়গায় পিছু হটলেও তারা বিমান বাহিনী ও ড্রোনের সাহায্যে বিদ্রোহীদের ওপর আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে বিপর্যায় নেমে এসেছে। অনেকে উদ্বাস্তু হিসেবে পালিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে এবং ৬ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হিসেবে জীবনযাপন করছে। মিয়ানমারের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।
‘অপারেশন ১০২৭’ শুরু হওয়ার পর চীনের মধ্যস্থতায় সহিংসতা বন্ধে জানুয়ারিতে শান রাজ্যে ব্রাদারহুড এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে যুদ্ধবিরতির পর ১০ জানুয়ারি থেকে উত্তর-পূর্ব শান রাজ্যে সাময়িকভাবে সংঘর্ষ বন্ধ থাকে। মিয়ানমার জান্তা এই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে বোমা বর্ষণ করার পর ব্রাদারহুড জোটের সদস্য তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) ২৫ জুন থেকে পুনরায় অভিযান শুরু করে। যুদ্ধবিরতি ভেঙে যাওয়ার পর প্রতিরোধ বাহিনী বড় শহরগুলো দখল করে নেয়ায় মিয়ানমারের সামরিক সরকার উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিম উপকূলের অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলো হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। আরকান আর্মি (এএ) বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী বন্দর ও পর্যটন শহর থান্ডওয়ে দখল অভিযানে প্রায় চার শ’র বেশি জান্তা সেনাকে হত্যা করেছে বলে জানায়। এর পাশাপাশি রাখাইনে এএ একটি বিমানবন্দর দখল করেছে। চলমান এই সংঘর্ষের পর তারা দখলকৃত সেনাক্যাম্পের অস্ত্র ও গোলাবারুদ হস্তগত করেছে।
গত ১৫ জুন টিএনএলএ অভিযান শুরু করার পরে এমএনডিএএ লাশিওর বিরুদ্ধে পুনরায় আক্রমণ শুরু করে। জান্তা তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বারবার বোমাবর্ষণ করে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করার কারণে তারা এই আক্রমণ শুরু করেছে বলে জানায়। টিএনএলএ এই আক্রমণকে ‘অপারেশন ১০২৭: ফেজ ২’ বলে অভিহিত করেছে এবং বেসামরিক জাতীয় ঐক্য সরকারের পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) সঙ্গে উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের চারটি টাউনশিপ এবং মান্দালয় অঞ্চলের মোগোক টাউনশিপে জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অপারেশন ১০২৭ এর দ্বিতীয় অংশ চলাকালীন দখল করা প্রথম শহর নওংকিও, শহরটি মান্দালয় অঞ্চলের পাইন ও লুইনের উত্তরের একটি জান্তা গ্যারিসন শহর। টিএনএলএ ও তাদের মিত্ররা উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের তিনটি শহর কিয়াউকমে, মংমিত ও নাওংকিও এবং মান্দালয় অঞ্চলের মোগোকে শহরের বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় চলমান সংঘর্ষে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ভাগ্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে থাইল্যান্ড মিয়ানমারে ৪৪০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে এবং মিয়ানমার থাইল্যান্ডে প্রায় ৪৪৩ কোটি ডলারের রপ্তানি করেছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে থাই-মিয়ানমার সীমান্তের মায়াওয়াদি শহরের সংক্ষিপ্ত দখল মায়ে সোট-মায়াওয়াদ্দিতে থাই-মিয়ানমার সীমান্ত বাণিজ্যকে হুমকির মুখে ফেলেছিলো। এই এলাকা দিয়ে প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য চলে। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে থাইল্যান্ড ছিলো মিয়ানমারে তৃতীয় বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে থাইল্যান্ডের পিটিটি মিয়ানমারের ইয়াদানা প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্পের বৃহত্তম শেয়ারহোল্ডার হয়ে ওঠে।
মিয়ানমারে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং আরো প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের বিষয়ে মিয়ানমারের অর্থ ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতে সহযোগিতা, ভারতের ঋণ ও কারিগরি সহায়তা এবং মিয়ানমারের কর্মকর্তাদের আরও প্রশিক্ষণ নিয়ে আলোচনা করতে রাষ্ট্রদূত ১৫ জুলাই মিয়ানমারের পরিকল্পনা ও অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। ডলার সংকট গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত সীমান্ত বাণিজ্যের জন্য কিয়াত এবং রুপিতে সরাসরি অর্থ প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়াতে রুপি-কিয়াত সরাসরি অর্থ প্রদান এবং কার্ড ও মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে আন্তসীমান্ত অর্থ প্রদানের বিষয়ে আলোচনা করেছে। ভারত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একটি পরিবহন ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে অব্যাহত সহযোগিতা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে এএ সংঘর্ষের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। গত ৪ জুনের পর থেকে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে কোনো পণ্যবোঝাই কার্গো ট্রলার বা জাহাজ আসছে না। ২০২৪ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ থেকে কোনো রপ্তানি পণ্য মিয়ানমারে যাচ্ছে না। এতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা দুশ্চিন্তায় রয়েছে। পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকার দিনে তিন-চার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। সীমান্তে চোরাচালান নিরুৎসাহিত করতে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের টেকনাফ ও মিয়ানমারের মংডুর মধ্যে সীমান্ত বাণিজ্য চালু করা হয়েছিলো।
টিএনএলএ যোদ্ধারা আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের সদর লাশিও শহর ঘিরে ফেলেছে। মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয় থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রধান মহাসড়কের পাশে লাশিও’র অবস্থান। মিয়ানমার চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। চীনের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্পে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। শান রাজ্যটি চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এখানে পাইপলাইন বসাচ্ছে চীন। সীমান্ত বাণিজ্য গেট বন্ধ করে দিয়ে এবং টিএনএলএ ও এমএনডিএএ’র নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে চীন ব্রাদারহুড জোটকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করার জন্য চাপ দিচ্ছে। টিএনএলএ শান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে ১৪ জুলাই থেকে ১৮ জুলাই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়ে চীনকে সহযোগিতা করেছে। তবে এই চুক্তিতে মান্দালয় অঞ্চল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সেখানে জোটের সদস্যরা জান্তা সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
সামরিক বাহিনী ও জাতিগত সংখ্যালঘু একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘর্ষের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান সোয়ে উইনের নেতৃত্বে ৭ জুলাই একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করে। তারা সীমান্তের স্থিতিশীলতা, মিয়ানমারে চীনা বিনিয়োগের নিরাপত্তা, অনলাইন স্ক্যাম অপারেশন নির্মূল, বাণিজ্য প্রচার এবং প্রস্তাবিত নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করে। জান্তা প্রধান মিন অং হ্লাইং আগামী বছর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং চীন এই প্রক্রিয়ায় সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমারের সাবেক প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন জুন মাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পাঁচটি মূলনীতি গ্রহণ উপলক্ষে বেইজিং সফর করে। সে সময় থেইন সেইন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, সোয়ে উইন উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যে চলমান লড়াই নিয়ে আলোচনা করেছে, যা জান্তার জরুরি অবস্থার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে প্রাধান্য পাবে।
মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় যে বিদ্রোহী গুষ্ঠিগুলো সমন্বিতভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একজোট হয়ে নিজ নিজ এলাকায় আক্রমণ পরিচালনা করছে। দশকের পর দশক ধরে তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত থেকেও এবারের মতো অর্জন কখনো পায়নি। এর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কিছু কিছু দলের সঙ্গে শান্তি ও সমঝোতা করে বাকিদের ওপর আক্রমণ চালাতো। এবার তাদের সেই কৌশল ব্যর্থ করে দিয়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো একতাবদ্ধ হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী সব ফ্রন্টে পরাজয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।
এবারের সংঘর্ষে লক্ষণীয় যে বিদ্রোহীরা মিয়ানমারে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর বাণিজ্য পথের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে এবং মিয়ানমার সরকারের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এর ফলে সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মিয়ানমারের এই সংঘাত বন্ধ করা জরুরি কারণের ফলে মিয়ানমারের সাধারণ জনগণের পাশাপাশি বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপরও চাপ পড়ছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রা চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিদ্রোহী ও মিয়ানমার সরকার উভয় পক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে এবং একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। জান্তা সরকার নির্বাচনের কথা ভাবছে এবং চীন নির্বাচনে সহায়তা করবে বলে জানিয়েছে যা উৎসাহব্যঞ্জক।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী আপাত দৃষ্টিতে কিছুটা কোণঠাসা হলে ও তাদের সামর্থ্য নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক অনেক শক্তিধর দেশ তাদের সমর্থন করে। বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আক্রমনের তীব্রতা বাড়াতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নিজস্ব অবকাঠামো ধ্বংস হবে ও হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে যা কখনো কাম্য নয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহীরা এবং সাধারণ মানুষ বোঝাতে পেরেছে যে একতাবদ্ধ হলে তারা অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারে ও তাদের অধিকার আদায়ে এগিয়ে যেতে পারে। এর বাস্তবতায় মিয়ানমারে একটা রাজনৈতিক সমাধান জরুরি। মিয়ানমারে শান্তি ফিরে আসলে মিয়ানমারের আপামর জনগণের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলো এবং আঞ্চলিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।
লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক