‘মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, গুণগত শিক্ষার বিস্তার’ স্লোগানকে সামনে রেখে সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী-প্রশিক্ষণার্থীরা মুজিব শতবর্ষ উদযাপন করছেন। দেশে গুণগত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষক প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত শিক্ষকের ভূমিকা অপরিসীম। দেশ ও জাতি গঠনে যোগ্য শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। মানসম্মত শিক্ষক দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে অমূল পরিবর্তন করতে পারে। যোগ্য শিক্ষকই পারে যোগ্য শিক্ষার্থী ও উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে। দেশ ও জাতির কল্যাণে শিক্ষকদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ রয়েছে প্রায় ১২৩টি, যেগুলো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত। বছর বছর তালিকা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়। অভিযোগের ভিত্তিতে কারো কারো ভর্তিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কলেজে বিএড ও এমএড কোর্স পরিচালনা করা হয় এবং বিভিন্ন স্তরের শিক্ষকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এছাড়াও এখানে আন্ডার গ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য বিএড (অনার্স) কোর্স চালু রয়েছে। সমতুল্য কোর্স ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরসহ বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও চালু রয়েছে।
বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে পড়ানো হলেও বাংলাদেশে শিক্ষা বিষয়ক বিশেষায়িত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই। ভারত, জার্মানি, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে এবং উল্লিখিত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্বিক শিক্ষামান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশেই শিক্ষায় পড়াশুনা ছাড়া কোনো পর্যায়েরই শিক্ষক হওয়া যায় না। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এসব দেশের শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বিএড (অনার্স) অর্থাৎ ৪ বছর মেয়াদি কোর্স পরিচালনা করে আসছে, যা আধুনিক মানসম্মত শিক্ষক তৈরিতে অত্যধিক ভূমিকা রাখছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার শিক্ষাকে গুরুত্ব দিলেও শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে এ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। যদিও যোগ্য, মানসম্মত শিক্ষক তৈরির জন্য আমাদের দেশেও একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি। আমার এই দাবিটি গত এক যুগ ধরে একাধিক শিক্ষাবিদ তাঁদের লেখায় তুলে ধরেছেন এবং শিক্ষা বিষয়ক দেশের একমাত্র পত্রিকা দৈনিক শিক্ষা তা প্রচার করেছে। অন্যান্য সংবাদপত্রের তা কমবেশি প্রকাশ হয়েছে।
শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা, শিক্ষাক্রম, শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতি, মূল্যায়ন পদ্ধতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষা বিষয়ক যে কোনো কার্যক্রমে গবেষণা করতে পারবে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন, এসডিজি অর্জনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সরকারকে সহযোগিতা করতে পারবে। এছাড়াও মানসম্মত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, বিএড (অনার্স) শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদান, জাতীয় ক্ষেত্রে শিক্ষক চাহিদা পূরণ ও গুণগত শিক্ষার বিস্তারে যথেষ্ট ভালো ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন, যুগোপযোগী শিক্ষার বিস্তারসহ সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী মানসম্মত, দক্ষ, ডিজিটালাইজড শিক্ষক তৈরি করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য আলাদা শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজের প্রয়োজন নেই। শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষকরা বিএড, এমএড ডিগ্রি গ্রহণসহ সকল প্রকার প্রশিক্ষণের আয়োজন করা যেতে পারে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ বিষয়ক একটি ইনস্টিটিউট খোলা যেতে পারে।
আমাদের দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ একটি বড় ধরনের সমস্যা। প্রবৃদ্ধি তত্ত্ব অনুযায়ী প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সাথে জড়িত হয়ে শিক্ষা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। শিক্ষায় প্রচুর বিনিয়োগ করে হংকং, দ. কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান অর্থনৈতিক ও জীবনমান উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। আমাদের উন্নত হতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং সঠিক বাস্তবায়ন। দেশকে সমৃদ্ধশালী করতে হলে মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। আমাদের রয়েছে মানবের প্রাচুর্য আর তা সম্পদে রূপান্তর করেই অর্থনৈতিক উন্নতির দিকে অগ্রসর হতে হবে। মানবসম্পদ ব্যবহারের সাথে সম্পর্ক উপযুক্ত শিক্ষার; যে শিক্ষার সাথে দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর একটি পরিকল্পিত সংযোগ থাকবে। ফলে উপযুক্ত, মানসম্মত, গুণগত, মানবসম্পদকে কাজে লাগানোর কৌশলগত শিক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ও গবেষণা করতে হলে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা জরুরি।
এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৪ নম্বর লক্ষ্যটি হলো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতা-ভিত্তিক মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সবার জন্য আজীবন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করা। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণের এই লক্ষ্যের সাথে বাকি ১৬টি লক্ষ্য সম্পর্কযুক্ত। এসডিজির প্রতিটি লক্ষ্য অর্জন করতে হলে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। আর মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতকরণে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
দেশে দক্ষ প্রকৌশলী তৈরিতে স্থাপিত হয়েছে প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়। দক্ষ চিকিৎসক তৈরিতে স্থাপিত হয়েছে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চর্চায় হয়েছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। সমুদ্রবিদ্যা বা নদীবিদ্যায় দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে স্থাপিত হয়েছে মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক গবেষণা ও এ বিষয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে স্থাপিত হয়েছে ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি খাতে গবেষণা ও শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে স্থাপিত হয়েছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা বাংলাদেশের একটি বিরাট ক্ষেত্র। কিন্তু শিক্ষা গবেষণাকে কেন্দ্র করে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়নি।
প্রশ্ন উঠতে পারে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় হতে পারে এবং সেখানে কি কি বিভাগ থাকতে পারে? শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের যে কোনো জায়গায় হতে পারে। তবে অবস্থান ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ঢাকার সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে করা যেতে পারে। এ কলেজটিকে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে এই শতবর্ষী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আরও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে। এ প্রতিষ্ঠানের শতবর্ষের ইতিহাস ছাড়াও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণ জায়গা (প্রায় ৯ একর)। এটি ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হওয়ায় সকল সরকারি-বেসরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজগুলোকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তকরণ ও সমন্বয় সাধনে সুবিধা হবে। সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজকে শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কার্যক্রম ছাড়াও অধিভুক্ত কলেজগুলোর নিয়মিত পাঠদান কার্যক্রম, গবেষণা কার্যক্রম ও অন্যান্য কার্যক্রমের সঠিক তত্ত্বাবধান করতে সুবিধা ও সামর্থ্য হবে। এটি রাজধানীতে অবস্থিত হওয়ায় শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা দেয়া হলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমস্যা তৈরি হবে না, দেশি-বিদেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে অধিকতর আগ্রহী হবে। শিক্ষা বিষয়ে এমফিল, পিএইচডি ডিগ্রিও দেয়া হবে, যা শিক্ষা বিষয়ে জ্ঞান চর্চা ও গবেষণা কার্যক্রমে একটি নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করতে পারে। এতে দেশ ও জাতির উন্নয়ন সাধন হবে।
শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো বিভাগ হতে পারে। যেমন: প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ; ভাষাশিক্ষা বিভাগ; সামাজিক বিজ্ঞান শিক্ষা বিভাগ; বিজ্ঞান, গণিত ও প্রযুক্তি শিক্ষা বিভাগ; শিক্ষা প্রশাসন বিভাগ; শিক্ষাক্রম ও শিক্ষণ প্রযুক্তি বিভাগ; উপানুষ্ঠানিক ও অব্যাহত শিক্ষা বিভাগ; শিক্ষা মনোবিজ্ঞান ও নির্দেশনা বিভাগ; শিক্ষা মূল্যায়ন ও গবেষণা বিভাগ; বিশেষ শিক্ষা বিভাগ; একীভূত শিক্ষা বিভাগ; শিক্ষায় নেতৃত্ব বিভাগ ইত্যাদি।
১৯৭১ পরবর্তী স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছরে আমাদের অনেক অর্জন থাকলেও গুণগত শিক্ষার প্রসার ও উন্নয়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে। আমরা জানি যে শিক্ষা আমাদের উন্নত রাষ্ট্র উপহার দিতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন যে উপযুক্ত শিক্ষা, শিক্ষার পরিবেশ , আর্থসামাজিক উন্নয়ন, প্রাইমারি, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষার কৌশলগত উন্নয়ন, যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি ও শিক্ষা গবেষণার উন্নয়নে একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে প্রতিটি জেলাতে একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় হবে এবং তার বাস্তবায়ন আজ দৃশ্যমান। তবে এত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় দৃষ্টিগোচর হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
একুশ শতকে পৃথিবীজুড়েই শিক্ষা একটি কৌশলগত ইস্যু। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে যে কোনো রাষ্ট্রকে শিক্ষানীতি, শিক্ষায় জেন্ডার সমতা, শিক্ষার বাজেট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ও মানসম্মত শিক্ষায় নিশ্চিতভাবেই গুরুত্ব দিতে হয়। এবং এর বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা একটি শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই সম্ভব।
মুজিব শতবর্ষে অর্থনৈতিক মুক্তি, উন্নত মানব তৈরি, এসডিজি অর্জন, শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে প্রতিষ্ঠা হোক শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হবার পর কৃষিতে যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে শিক্ষার সকল ক্ষেত্রেও বিপ্লব সাধন হবে। এতে করে বাংলাদেশের প্লাটিনাম জয়ন্তীতে আমরা উন্নত রাষ্ট্রে পদার্পণ করব বলে বিশ্বাস করি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নততর করতে বর্তমান সরকার প্রধান, শিক্ষাবান্ধব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
লেখক : লিমন হোসেন, বিএড (অনার্স) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, ঢাকা।
[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]