মুডি’স রেটিংয়ে বাংলাদেশের অবনমন, দুর্বল হচ্ছে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

আন্তর্জাতিক ঋণমান সংস্থা মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস বাংলাদেশ সরকারের লং টার্ম ইস্যুয়ার ও সিনিয়র আনসিকিউরড রেটিং ‘বিএ৩’ থেকে অবনমন করে ‘বি১’ নির্ধারণ করেছে। একই সঙ্গে শর্ট টার্ম ইস্যুয়ার রেটিং (স্বল্পমেয়াদি ঋণ বাধ্যবাধকতা পূরণের সামর্থ্য) নির্ধারণ করেছে ‘নট প্রাইম’। এর মাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের রেটিং অবনমন পর্যালোচনার যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশ নিয়ে গতকালই এ রেটিং প্রকাশ করেছে মুডি’স।

মুডি’সের মূল্যায়নে বলা হয়েছে, চলমান সংকটের সময়টিতে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বাহ্যিক দুর্বলতা ও তারল্য ঝুঁকি এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার বিষয়টি সামনে এসেছে। বাংলাদেশের সভরেন ক্রেডিট প্রোফাইল ‘বি১’ রেটিংয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। কিছুটা শিথিল হওয়া সত্ত্বেও চলমান ডলার ঘাটতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার বিষয়টি থেকে বাংলাদেশের বহিস্থ অবস্থানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটছে।

দেখা দিচ্ছে জ্বালানি সংকট। সরকার এখনো আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগটি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি এবং একাধিক বিনিময় হার ও সুদহারের সীমার মতো অপ্রচলিত উদ্যোগ বিশৃঙ্খলার কারণ হয়ে উঠেছে। সর্বোপরি অর্থনীতির আকারের তুলনায় রাজস্ব আহরণ অত্যন্ত কম। বিষয়টিতে সরকারের নীতিগত সক্ষমতা ব্যাহত হচ্ছে। টাকার অবমূল্যায়নের কারণে স্বল্পমেয়াদের অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। একই সঙ্গে দুর্বল হচ্ছে সরকারের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা। 

মুডি’স মনে করছে, বাংলাদেশের আর্থিক সক্ষমতাকে দুর্বল করবে ঋণের পরিমাণ। এছাড়া আর্থিক সংস্কার বাস্তবায়ন হতেও কয়েক বছর সময় লাগবে। একই সঙ্গে মুডি’স বাংলাদেশের স্থানীয় মুদ্রাকে ‘বিএ১’ থেকে ‘বিএ২’ এবং বৈদেশিক মুদ্রার সীমাকে ‘বিএ৩’ থেকে ‘বি১’-এ নামিয়ে এনেছে। সভরেন রেটিংয়ের চেয়ে স্থানীয় মুদ্রার সীমা দুই ধাপ ওপরে রয়েছে। স্থানীয় মুদ্রার সীমার চেয়ে দুই ধাপ নিচে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার সীমা।

মুডি’সের মূল্যায়ন অনুসারে, বাংলাদেশের বাহ্যিক অবস্থান অতিমারীর আগের সময়ের তুলনায় কাঠামোগতভাবে দুর্বল থাকবে। তবে বিদেশী অর্থায়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাবে বলে প্রত্যাশা করছে সংস্থাটি। 

২০২৪ খিষ্টাব্দের জুনের শেষ নাগাদ রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারে বলে মনে করছে মুডি’স। তবে সেক্ষেত্রেও রিজার্ভ কভিডপূর্ব পর্যায়ে যেতে দু-তিন বছর লেগে যেতে পারে। বাংলাদেশের রিজার্ভ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উঠেছিল ২০২১ খিষ্টাব্দের আগস্টে। তখন থেকে এ পর্যন্ত রিজার্ভ কমেছে ১৭ বিলিয়ন ডলার বা ৪০ শতাংশ। চলতি বছরের এপ্রিল শেষে রিজার্ভের পরিমাণ ২৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা দিয়ে ৩ দশমিক ৭ মাসের পণ্য ও সেবা আমদানি করা যাবে। ২০২১ খিষ্টাব্দের আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে সাত মাসের আমদানি চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল। আমদানিতে বিধিনিষেধ ও জ্বালানিতে কৃচ্ছ্রসাধন সত্ত্বেও এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়ন ও আমদানিতে বিধিনিষেধের পাশাপাশি স্থিতিশীল রফতানির পাশাপাশি রেমিট্যান্স প্রবাহের কারণে চলতি হিসাব উদ্বৃত্ত হয়েছে। তবে জ্বালানি পণ্যের দামের কারণে চলতি হিসাবের ওপর চাপ অব্যাহত থাকবে।

 

মুডি’সের পূর্বাভাস, বাংলাদেশের মোট (গ্রস) রিজার্ভ আগামী দু-তিন বছর ৩০ বিলিয়ন ডলারের নিচেই থাকবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তমাফিক এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) বাদ দিয়ে হিসাব করা হলে নিট রিজার্ভের পরিমাণ আরো কমবে। 

মুডি’স মনে করছে বাংলাদেশের আমদানির সক্ষমতার অনুপাত তিন মাসের আশপাশে স্থির থাকবে। সংস্থাটির এক্সটার্নাল ভালনারেবিলিটি ইন্ডিকেটর (ইভিআই) অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশের নিট রিজার্ভ আনুমানিক ২০ বিলিয়ন ডলার, যা দিয়ে ২ দশমিক ৭ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।

ধারাবাহিক নিম্ন রাজস্ব ও ক্রমবর্ধমান সুদ পরিশোধের কারণে আর্থিক অবস্থা বিশেষ করে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা দুর্বল হবে। জ্বালানি, সার ও খাদ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সরকারের ভর্তুকি বেড়ে যাওয়ায় ঋণের পরিমাণ বাড়বে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের বাজেট ঘাটতি বাড়াবে। অন্যদিকে আমদানিতে বিধিনিষেধের কারণে রাজস্ব আয় কমে গেছে। আর্থিক ঘাটতি আগামী পাঁচ বছরে জিডিপির ৫ থেকে সাড়ে ৫ শতাংশে থাকবে বলে মনে করছে মুডি’স। ২০২৬ অর্থবছর শেষে ঋণের পরিমাণ বেড়ে জিডিপির ৪০ শতাংশে দাঁড়াবে, যা ২০২২ অর্থবছর শেষে জিডিপির ৩০ শতাংশের নিচে ছিল।

তবে বাংলাদেশের ঋণের বোঝা প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সহনীয় থাকবে এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিশোধের সুযোগ থাকায় বৈদেশিক ঋণ পরিশোধযোগ্য অবস্থায় থাকবে বলে মনে করছে মুডি’স। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, সরকারের রাজস্ব আহরণ অনেক কম হলেও এর একটি বড় অংশই চলে যাবে সুদ পরিশোধে। ২০২৩ থেকে ২০২৫ অর্থবছরে সুদ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে রাজস্ব আহরণের ২৫ শতাংশে উন্নীত হবে, যা ২০১৯ অর্থবছরে ছিল আহরিত রাজস্বের ২০ শতাংশেরও নিচে। 

মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘মুডি’স বাংলাদেশের কিছু ব্যাংকের রেটিং এর আগেই অবনমন করেছিল। এখন সার্বিকভাবে দেশের রেটিং অবনমন করেছে। এর ফলে বিদেশী ঋণের সুদহার ও আনুষঙ্গিক ফি বেড়ে যাবে। পাশাপাশি ঋণ নিয়ে দরকষাকষির সুযোগও সংকুচিত হয়ে আসবে। কিছু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিতে পারে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট আরো বাড়তে পারে।’

কোন ফ্যাক্টরগুলোর কারণে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের রেটিংয়ের আরো অবনমন কিংবা উন্নতি হতে পাবে সে বিষয়েও ইঙ্গিত দিয়ে মুডি’স। সংস্থাটির মতে, সরকারের রাজস্ব সংস্কার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি, যা রাজস্ব আহরণ সক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেবে এবং এর ফলে ঋণ সক্ষমতা ও ফিসক্যাল স্পেস বাড়বে। মুডি’সের প্রত্যাশার চেয়েও বৈদেশিক মুদ্রা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়া। তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরতার বাইরে অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনার ক্ষেত্রে বস্তুগত উন্নতি, প্রধান অবকাঠামোগত উন্নতি, যা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাকে বাড়িয়ে দেবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল করতে বিদেশী বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলো বাংলাদেশের রেটিংয়ে উন্নতি আনতে পারে। 

বাংলাদেশের সামাজিক ঝুঁকির অবস্থানও বেশ নেতিবাচক পর্যায়ে। উচ্চ ও স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার কমেছে। এতে মৌলিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষার সুযোগ ও ফলাফল, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা এবং জনশক্তিকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মতো বিষয়গুলো সামাজিক ঝুঁকি হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশের দুর্বল প্রতিষ্ঠান ও সুশাসন পরিস্থিতি এর রেটিংকে সীমাবদ্ধ করেছে এবং এতে গর্ভন্যান্স ইস্যুয়ার প্রোফাইল স্কোর ‘জি৪’ দাঁড়িয়েছে, যা উচ্চমাত্রায় নেতিবাচক। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় চ্যালেঞ্জের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করছে, যেখানে আইনি কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতাও সীমিত। এসব সুশাসন চ্যালেঞ্জের বিষয়টি ব্যাংক খাতের সম্পদের মানের ক্ষেত্রেও আংশিক অবদান রেখেছে। পাশাপাশি একটি অবনতিশীল মুদ্রানীতি কাঠামো সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতাকে অবমূল্যায়িত করেছে এবং আর্থিক বিচক্ষণতাকে চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলেছে বলে মনে করছে মুডি’স।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ - dainik shiksha পুলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার সুপারিশ সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha সড়ক-রেলপথ ছাড়লেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম - dainik shiksha ফেসবুকে সতর্কবার্তা দিলেন সারজিস আলম আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে - dainik shiksha আওয়ামী আমলে শত কোটি টাকা লুট শিক্ষা প্রকৌশলের চট্টগ্রাম দপ্তরে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে কমিটি গঠন করা হয়েছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটির তালিকা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে - dainik shiksha ছাত্ররা রাজনৈতিক দল ঘোষণা করবে কি না জনগণ নির্ধারণ করবে কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি - dainik shiksha কুয়েটে ভর্তি আবেদন শুরু ৪ ডিসেম্বর, পরীক্ষা ১১ জানুয়ারি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0024909973144531