মেঘনার মোহনায় শিক্ষা বঞ্চনা

বোরহানুল হক সম্রাট |

পদ্মা ও যমুনার মিলিত ধারা যেখানে মেঘনার স্রোতে গা ভাসায়, সেখানে ডাকাতিয়ারও সাধ হয় সমুদ্রে যাবার। তিন নদীর মিলনে এসে নিজেকে বিসর্জন দেয় সে। এরপর যে স্রোতধারা তৈরি হয় তাতে বয়ে চলে বাংলাদেশের অধিকাংশ প্রধান নদীর পানি।  পাহাড়ি ঢল নিয়ে মেঘনার সমুদ্রযাত্রায় সওয়ার হয় ব্রক্ষপুত্র, সুরমা, কুশিয়ারাসহ অনেক নদীর পানি ও পলি। ফলে মেঘনা তার বিশালতা দেখাতে শুরু করে। এই বিশালতা এতোটাই বিস্তীর্ণ যে কোথায় কতো জোরে বইছে হিসেব কষাটা কঠিন হয়ে পড়ে। সেই বেহিসাবি নদী যেনো এক সময় তার পাড় ভুলে যায়। এক পাড় থেকে যেমন সমুদ্রের অপর পাড় দেখা যায় না, সেভাবে মেঘনাও কোথাও কোথাও যেন পাড় হারা। একপাড়ের মানুষ দেখতে পায় না আরেকপাড়কে। 

চরগাসিয়ার একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নূরানী মাদরাসা। এ চরে তৃতীয় শ্রেণির পরে পড়াশোনার সুযোগ নেই

এতো বিপুল প্রশস্ততা নিয়ে বয়ে চলা কঠিন। মেঘনার স্রোত তাই মন্থর হয়, বিভক্ত হয়। বিভক্ত রেখার মাঝে মাঝে জেগে ওঠা চরে গড়ে ওঠে বসতি। জন্ম নেয় নতুন জনম, নতুন ঠিকানা।

মেঘনার সাগর সঙ্গমে জেগে ওঠা এসব চর বাংলাদেশকে নতুন জমির সন্ধান দিয়েছে। সেসব জমিতে গড়ে উঠেছে নদী ভাঙ্গণে সব হারা মানুষের বসত। যে নদী নি:স্ব করেছে তাদের সেই নদীই ফিরিয়ে দিয়েছে পায়ের নিচে মাটি। নোয়াখালী জেলার ভাটিতে এমনভাবেই এক সময় গড়ে উঠেছিল হাতিয়া দ্বীপ। সেই হাতিয়াতে এখন সড়কে যানজট হয়, সেই হাতিয়া এখন গভীর রাতে ঘনকালো অন্ধকারে ডুবে যায় না। আলোর বিচ্ছুরণে ঝলমল করে। কিন্তু, দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সব চর-উপচরে আলোর ঝলকানি পৌঁছেনি। সম্প্রতি সফর করে আসা ভাসান চর আর চরগাসিয়ার মৌলিক তুলনা নিয়েই এ গল্পের অবতারণা।  

প্রায় এক দশক আগে চরগাসিয়াতে নিজ দায়িত্বে বসত গড়েন কয়েক হাজার মানুষ। তাদের সংখ্যা এখন ১৭ হাজার ছাড়িয়েছে। বেশিরভাগই নদীভাঙা পরিবার। অন্যজেলার আছেন কিছু, যারা বিস্তীর্ণ ভূমিতে বাসের সুবিধা নিতে চলে এসেছেন। এখানে কোনো সীমান্তের পাহারাদার নেই। একপা এগুলেই জীবন হারানোর ভয় নেই। কিন্তু আছে টিকে থাকার ভিন্ন ভয়।

হাতিয়ার মূল ভূখণ্ড থেকে নৌকায় চরগাসিয়ায় যেতে সময় লাগে ঘন্টাখানেক। স্পিডবোডে উত্তাল মেঘনার জলরাশির আঘাত সইতে পারলে যাওয়া যায় ২৫ মিনিটে। বিচ্ছিন্ন এই ভূখণ্ড সুখচর ইউনিয়নের বলে জানা যায় বটে। তবে জাতীয় তথ্য বাতায়নে এই দ্বীপ সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। মানচিত্রেও স্থানটি চিহ্নিত করা যায় হয়নি। বাংলাপিডিয়ার মানচিত্রে এর অস্তিত্ব নেই। এমনকি গুগল মানচিত্রেও দ্বীপটির অবস্থান উল্লেখ করা হয়নি।  

এই দ্বীপে যারা বসবাস করেন, তাদের দায় যেনো কারোরই নয়। সেখানে মেয়েরা মা হয় গভীর সংশয়ে, প্রসবের সময়ে কে তার পাশে থাকবেন তার দুশ্চিন্তায়। সেখানে সন্তানরা বড় হয় স্কুল পড়ার কোনো সম্ভাবনার খোঁজ না পেয়েই। সেখানে কৃষক তার লাগানো ধানের চারা একটু বড় হতেই শঙ্কায় থাকেন নতুন করে প্লাবিত হবার। এই মেট্রোরেলের যুগে একটি হাসপাতাল বা ক্ষুদ্রতম স্বাস্থ্যসেবা ছাড়াও বিশাল জনভূমি টিকে রয়েছে বছরের পর বছর। কমপক্ষে ২ হাজার শিশু সেখানে বড় হচ্ছে লেখাপড়া ছাড়া, যাদের জন্য চরে আছে একটি মাত্র নুরানি মাদরাসা। সে মাদরাসায় শিশুদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওরা চমকে ওঠে, ভড়কে যায়। বিস্তীর্ণ জনপদে এসব শিশুর জন্য সেই মাদরাসায় ক্লাস থ্রির ওপরে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা নেই।

কিন্তু মেঘনার বুকের সব চরের গল্প এমন নয়। হাতিয়ার আরেকপাশে একই উপজেলায় যে ভাসানচর,  সেখানে প্রতিটি মানুষের সব বেলার খাবারের নিশ্চয়তা আছে। সেখানে প্রত্যেক মায়ের জন্য স্বাস্থ্য সেবা আছে। প্রতিটি শিশুর পড়াশোনার দায় নেয়ার সংস্থা বা রাষ্ট্রের অভাব নেই। এবং সেখানে যারা বাস করেন তারা কেউই এই দেশের মানুষ নন। তাদেরকে রোহিঙ্গা বলা হয়। যদিও সেখানে বাস করা ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গার অনেকের মনেই এভাবে জীবন কাটানোর বিরোধিতা আছে। সেখানকার প্রত্যেক মানুষের বেঁচে থাকার ন্যুনতম অধিকারকে দারুণভাবে নিশ্চিত করাকে আপাতত সমর্থন না করার সুযোগ কোনো বিবেক সম্পন্ন মানুষের নেই। যথাযথ প্রত্যাবাসনসহ তাদের মৌলিক অধিকার পূরণ না হওয়াটা এই পৃথিবীর এক বড় দায় বলেই মনে হয়। কিন্তু, এমন নিশ্চিত জীবনের পরও যেমন ভাসানচরে যাওয়ার বদলে রোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার খবর আসে, তেমনই নদী ভাঙ্গা মানুষ প্রমত্তা মেঘনার ঢেউ ঠেলে বেঁচে থাকার তাগিদেই গাসিয়ায় চরে ঘর করে। এসবই বাস্তবতা। 

কিন্তু একই নদীর বুকে পাশাপাশি গড়ে ওঠা দুই চরের মানুষের জীবন কতোটা ভিন্ন হতে পারে? চরগাসিয়ার মানুষগুলো এমন প্রশ্ন আমাদের করেছিলেন, যখন তাদের কাছে আমরা পৌঁছেছিলাম। প্রায় ৫ হাজার একর আয়তনের সেই চরে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের শত ঘর পড়ে আছে কোনো বাসিন্দা ছাড়াই। সেই ঘরগুলোতে কেনো কেউ থাকে না-জানতে চাইলে বললেন, কী খাবেন এখানে বাসকরা মানুষ। কী হবে তাদের জীবিকা-সেটা নিশ্চিত না হলে শুধু ঘরের ওপরে ছাদ থাকলেই কী চলে। ফলে ঘরগুলো শূন্য পড়ে থাকে। অন্যরা যারা বাস করেন নিজেদের ঘরে তারা হয় মৎসজীবী, নয় সংশয়ী কৃষিজীবী। 

হাতিয়া দ্বীপ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তোফায়েল আহমেদও নোয়াখালীর নদীভাঙা পরিবারের সন্তান। বসত ভাঙা আর গড়ার যাতনা তার জানা। বলছিলেন, মেঘনায় যতো চর জেগে উঠছে ধীরে ধীরে সেগুলো এক হয়ে গেলে তৈরি হবে আরেক বাংলাদেশ। সেখানে বাস শুরু করা মানুষের জন্য ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বাঁধ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু জরুরি। চরে নিজ দায়িত্বে বসবাস শুরু করা মানুষের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও বণ্টন নিয়ে স্থানীয় প্রশাসন কাজ করছে বলে শুনছি। 

চরগাসিয়ার এক বাসিন্দা জানান, গরু-মহিষ অথবা ভেড়ার বাথানের জন্য যে পশু চিকিৎসক আসেন তার কাছ থেকেও তারা নিজেদের চিকিৎসার ওষুধ লিখে নিয়েছেন অনেকবার। শুধু চিকিৎসার অভাবে মারা গেছেন কে কে সে কথাও বলতে চাইলেন অনেকে। এমন বাস্তবতার মধ্যেই বসতি গড়ার আয়োজন চলছে পাশের চর মোহাম্মদ আলী, দমারচর, চর আয়েশা অথবা ১০ হাজার একরের চর গাঙ্গুরিয়ায়। বাইরে থেকে কেউ গেলে তারা অভিযোগের ডালা খুলে বসেন। এসব চরে যোগাযোগের কাদামাখা পথটাই ভরসা। 

চরগাসিয়ার জনতার বাজারে বসে কথা হয় তৈমুর আমার মাকসুদের সঙ্গে। বলছিলেন, চরের চারপাশে বাঁধ, মাঝখান দিয়ে ন্যুনতম রাস্তা, একটা স্কুল আর স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রের দাবির কথা। মেট্রোরেল আর উড়াল সড়কের খবর তারা জেনেছেন। শুনেছেন নিজের টাকায় পদ্মাসেতু চালুর খবরও। ওই অঞ্চলের মানুষের বেশি যোগাযোগ চট্টগ্রামের সাথে। স্থানীয় বারো আউলিয়ার মাজারের বাজারের মানুষেরাও জেনেছেন কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে আমাদের টানেল নির্মাণের এগিয়ে যাওয়াটার খবর। তারা জানেন, পাহাড় ভেদ করে কক্সবাজারেও চলে গেছে আমাদের রেল। এসব খবর জেনে, গল্প শুনে আর নিজেদের বঞ্চণার নিদারুণ কষ্টের কথা ভেবে এসব পিছিয়ে থাকা মানুষ আর শিশুরা আমাদেরকে নিয়ে কী ভাবে কে জানে? আর কতো মানুষ এক সঙ্গে হলে, আর কতোদিন এভাবে বসবাস করলে তাদের দিকে ফিরে তাকাবো আমরা?  

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম - dainik shiksha ডিআইএর নতুন পরিচালক অধ্যাপক আবু কাইয়ুম জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান - dainik shiksha জাতীয়করণসহ তিন দাবিতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দপ্তরিদের অবস্থান এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা - dainik shiksha এমপিওর দাবিতে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় শিক্ষকদের পদযাত্রা কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি - dainik shiksha কারিগরিতে ৪০ শতাংশ নম্বরে উপবৃত্তি কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের - dainik shiksha কাউকে হেনস্তা না করার আহ্বান বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক - dainik shiksha আটকের পর বিজিবিকে যে প্রলোভন দেখান বিচারপতি মানিক নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha নয় বছরের শিক্ষিকাকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হতে বললেন প্রধান শিক্ষক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029690265655518