মেধার অপচয় বনাম আন্তঃক্যাডার বৈষম্য

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রকৌশলী ও ডাক্তারগণ বিসিএসের পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে সুযোগ পাওয়ায় মেধার অপচয় হচ্ছে— এমন একটি ইস্যু নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিতর্ক চলছে। ৩৮তম বিসিএসে পররাষ্ট্র ক্যাডারের ২৫ জনের মধ্যে সাত জন ডাক্তার, আট জন ইঞ্জিনিয়ার ও দুই জন কৃষিবিদ সুযোগ পেয়েছেন। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক ডাক্তার এবং বিভিন্ন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের আড়াই শতাধিক ইঞ্জিনিয়ার টেকনিক্যাল ক্যাডারের পরিবর্তে পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে সুযোগ পেয়েছেন।বলা হচ্ছে, এসব বিশেষায়িত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা টেকনিক্যাল ক্যাডারে গেলে মেধার অপচয় হতো না, দেশ এদের কাছ থেকে অনেক ভালো সেবা পেত। এই যুক্তিকে অবহেলা করার সুযোগ নেই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পযার্য়ের প্রতিটি বিষয় কি তবে বিশেষায়িত নয়? বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি বিষয়ের স্বতন্ত্র শিক্ষাক্রম আছে এবং প্রতিটি বিষয়ের লক্ষ্য নতুন জ্ঞানের উদ্ভাবন, ঐ বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি। এই বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিটি বিষয়ই বিশেষায়িত এবং চাকরির বাজারের বিবেচনায় প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মেধার অপচয় ঘটছে। বৃহস্পতিবার (৩০ জুলাই) ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, বর্তমানে বিসিএসে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, শুল্ক ও আবগারি, নিরীক্ষা ও হিসাবসহ মোট ১৪টি সাধারণ ক্যাডার আছে, যেগুলোতে যে কোনো বিষয়ের শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারেন। সাধারণ শিক্ষা, কৃষি, মত্স, স্বাস্থ্য, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলসহ মোট ১২টি প্রফেশনাল ক্যাডার রয়েছে, যেগুলোতে কেবল ঐ বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনকারীগণই আবেদন করতে পারেন। প্রফেশনাল ক্যাডারের মাধ্যেমে অর্জিত বিদ্যার প্রয়োগ ঘটানো যায় বলে সেগুলো নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সমস্যা হলো সাধারণ ক্যাডার নিয়ে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা পররাষ্ট্র ক্যাডারে; লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা প্রশাসন ক্যাডারে; ব্যবসায় অনুষদের শিক্ষার্থীরা শুল্ক ও আবগারি, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং বাণিজ্য ক্যাডারে; ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্সের শিক্ষার্থীরা পুলিশ ক্যাডারে; তথ্যবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা তথ্য ক্যাডারে—ঠিক এমনিভাবে অন্যান্য সাধারণ ক্যাডারেও যদি বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ করা যেত, তবে হয়তো মেধার অপচয় হওয়া নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, সেটা হতো না। শুধু ক্যাডার সার্ভিসই নয়, প্রায় অধিকাংশ সরকারি চাকরিতেই বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় না। বিভিন্ন বিশেষায়িত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে যেমন বিষয়ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেলেও বেশির ভাগ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও বিষয়জ্ঞানকে খুব একটা প্রাধান্য দেওয়া হয় না। এর কারণ আমাদের দেশে এখনো তেমনভাবে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি এবং আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকেও সেদিকে নিয়ে যেতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাকে আমরা অনেকাংশেই সার্টিফিকেট-সবর্স্ব করে তুলেছি। ফলে সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে বিষয়জ্ঞান নিয়ে চাকরিদাতাদের তেমন একটা মাথাব্যথা না থাকায় মেধার অপচয় হয়ে আসছে দীর্ঘকাল ধরেই।

কেন বিসিএসে নিজেদের টেকনিক্যাল ক্যাডার ছেড়ে সবাই পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে যোগ দিতে চায়? আন্তঃক্যাডার বৈষম্য এবং সমাজের মানুষের মনোভাব এর মূল কারণ। বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত চাকরি পুনর্গঠন ও শর্তাবলি অ্যাক্ট, ১৯৭৫ অনুযায়ী একই গ্রেডে এবং স্কেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও সুবিধার ক্ষেত্রে বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ক্যাডার বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও পুলিশ ক্যাডারে যোগদানের পাঁচ বছর অতিক্রম করলে পদোন্নতি পেয়ে তারা ষষ্ঠ গ্রেডে চলে যায়। কিন্তু টেকনিক্যাল ক্যাডার সার্ভিসের অবস্থা এদিক দিয়ে খুবই করুণ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের অবস্থা তো ভয়াবহ। শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতির পরিবর্তে বিষয়ভিত্তিক পদোন্নতির কারণে ৮-১০ বছর লেগে যায় প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক হতে। স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদানের পর প্রমোশনের জন্য অতিরিক্ত ডিগ্রি অর্জন করার বাধ্যবাধকতায় পদোন্নতি পেতে ১৫-১৬ বছর লেগে যায়। দেখা যায়, একই ব্যাচে যোগদানকারী সাধারণ ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ যখন পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় বা চতুর্থ গ্রেডে অবস্থান করছেন, তখন টেকনিক্যাল ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ ষষ্ঠ গ্রেডে অবস্থান করছেন।

প্রশাসন ক্যাডারের ২৫তম ব্যাচের কমকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কৃষি ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের একই সময়ে উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। এই আকাশ-পাতাল তফাত কি এদের মধ্যে হতাশা তৈরি করে না? অনেক সময়ই দেখা যায় জুনিয়র ব্যাচের ডিসি ও ইউএনওর কাছে অন্যান্য ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। বছর পাঁচেক আগের একটি সংবাদের কথা উল্লেখ করছি, যেখানে শিক্ষা ক্যাডারের এক কর্মকর্তাকে পা ধরে মাপ চাওয়াতে বাধ্য করেছিলেন তার থেকে বেশ কয়েক ব্যাচ জুনিয়র এক প্রশাসনের কর্মকর্তা। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা পরীক্ষা চলাকালীন ঐ ম্যাজিস্ট্রেটকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে নিষেধ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি তাকে পা ধরে মাপ চাওয়াতে বাধ্য করেন। বছর তিনেক আগে একজন অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জনের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করায় এডিসি ও ইউএনওকে ভর্ত্সনা করেছিল আদালত। এরকম আরো অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারের জুনিয়র কর্মকর্তা দ্বারা অন্যান্য ক্যাডারের সিনিয়র কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। কর্তৃত্ব বা ক্ষমতা প্রদর্শনের এই প্রবণতা টেকনিক্যাল ক্যাডারসহ অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিক্ষুব্ধ করার পক্ষে কি যথেষ্ট নয়?

সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও ক্যাডার সার্ভিসগুলোর মধ্যে আছে বিস্তর ফারাক। আবাসিক সুবিধা, গাড়ির সুবিধা, হাসপাতালের সুবিধা, ব্যক্তিগত সহকারী সুবিধা, মোবাইল ভাতা, ইন্টারনেট ভাতা, বাবুর্চি ভাতা, প্রহরী ভাতা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রশাসনসহ মাত্র কয়েকটি ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাগণই ভোগ করেন। উচ্চতর পড়ালেখার জন্য বিভিন্ন বিদেশি বৃত্তি এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শিক্ষা ক্যাডারসহ অন্যান্য টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য বেশি প্রযোজ্য হলেও সেগুলোর বেশির ভাগই প্রশাসনসহ কয়েকটি সাধারণ ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভোগ করতে দেখা যায়। উপসচিবদের গাড়ি কেনা ও পরিচালনার সুবিধা দেওয়া হয়, অথচ কলেজের অধ্যক্ষদের পায়ে হেঁটে অফিস করতে হয়।

অনেক ক্যাডারের সুপারনিউমোরারি পদ তো দূরের কথা, গ্রেড ১ পর্যন্ত ওঠার সুযোগ পর্যন্ত জোটে না। মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা সিনিয়র সচিব হওয়ার সৌভাগ্য খুবই কম হয়। প্রশাসন ক্যাডার থেকেই সাধারণত মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা সিনিয়র সচিব করা হয়। আর তাদের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করেই অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের কার্যাবলি পরিচালিত হয়। অথচ ক্যাডারভিত্তিক সচিব করা হলে বিশেষায়িত জ্ঞান ও তৃণমূল অভিজ্ঞতার ফলে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে উন্নয়নের গতি আরো ত্বরান্বিত হতো। তবে এরকম কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া এবং সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য দিনকে দিন ক্যাডার অসন্তোষ সৃষ্টি করছে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। এদেশের সরকার পরিচালনায় প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিসই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই কোনোভাবেই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কাম্য নয়। অনেকে হয়তো বলতে পারেন, মেধাতালিকায় যারা শীর্ষে থাকেন, তারাই পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে যান। ফলে তারা বাড়তি কিছু সুবিধা পেতেই পারেন। এটা মেনে নেওয়া যেত, যদি ক্যাডার পছন্দের বিষয়টা না থাকত।

আন্তঃক্যাডার বৈষম্য সম্পর্কে এই যুগের চাকরিপ্রার্থীরা বেশ ওয়াকিবহাল। আগে শিক্ষার্থীরা এত ক্যারিয়ার-সচেতন ছিল না। শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাডার বৈষম্য সম্পর্কে জানছে। প্রকৌশল ও মেডিক্যালের শিক্ষার্থীরা যদি পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ ক্যাডারে যেতে চায়, তাহলে এতে তো তাদের কোনো দোষ দেখি না। দোষ আমাদের সিস্টেমের। যতদিন না আন্তঃক্যাডার বৈষম্য হ্রাস হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত টেকনিক্যাল ক্যাডারের পরিবর্তে এসব ক্যাডারের দিকেই চাকরিপ্রার্থীরা ঝোঁকার চেষ্টা করবে।

লেখক : আরিফুর রহমান, শিক্ষক, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043661594390869