মেধা কেন পাচার হয়?

এম.এস. দোহা |

প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর আমরা নতুন করে পরিচতি হই এক ঝাঁক মেধাবীর সাথে। কিছুদিন ধরে চলে হইচই। এরপর খবর থাকে না। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পর্যাপ্ত আসন না থাকায় ছিটকে পড়ে অনেক মেধাবী। আবার পড়াশুনা শেষ হলেও এই দেশের অনেক মেধাবী সন্তানকে ধরে রাখা যায় না।

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকেই বাংলাদেশকে গুডবাই জানিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা পাড়ি দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ উচ্চ শিক্ষার সম্মানসূচক ডিগ্রি বা থিসিসের জন্য বিদেশ গেলেও তাদের অনেকেই নির্ধারিত সময়ে দেশে ফিরে আসেন না। আবার আর্থিক ও বিশেষ সুবিধার কারণে মেধাবীরা অধ্যাপনা বাদ দিয়ে চলে যাচ্ছেন ভিন্ন চাকরিতে—এমন দৃষ্টান্তও কম নয়। এতে শিক্ষাঙ্গনে যোগ্য শিক্ষকের অভাব লক্ষণীয়। এক জরিপে দেখা গেছে, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া ছাত্রদের ৯৯ জনই পরবর্তীতে চলে যান বিদেশে। ১ম থেকে ১৫তম স্থান অধিকারী ছাত্রদের অবস্থান বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন, পদার্থ ও পরিসংখ্যানে পাসকৃত মেধাবী ছাত্রদের অধিকাংশই এখন বিদেশে। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে মেধাবী ডাক্তাররা পাস করার পর উচ্চ শিক্ষা নিতে বিদেশে গিয়ে দেশে ফিরছেন এ ধরনের নজির খুব কম।

এটা স্বীকার করতে অসুবিধা নেই যে, মেধাবীদের জন্য আমরা কাঙ্খিত কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি করতে পারছি না। দিতে পারছি না যথাযথ পারিশ্রমিক। ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়েই বিদেশে পাড়ি দিতে বাধ্য হন তারা। যা এখন বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ঢাকা গভ: ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের একটি ডাইরেক্টরিতে মেধা পাচারের উল্লেখযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায়। ১৯৭৩ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কে কোথায় আছেন তা অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ বিষয়টি ধরা পড়ে। ওই ব্যাচের ৮৪ জন ছাত্রের মধ্যে ৩৫ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কারণ, তারা বিদেশে অবস্থান করছেন। অনেকেই স্থায়ীভাবে বিদেশে অবস্থান করছেন। অনেকে স্থায়ীভাবে বিদেশে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশে অবস্থানকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছেন বিদেশে পাড়ি জমাবার জন্য। কেননা তারা মনে করেন, এদেশে ভালো কিছু করা অসম্ভব। তাদের মেধার মূল্যায়ণ হবে না। অবশ্য এসব মেধাবীকে দেশের কাজে লাগানোর জন্য সরকারের ব্যাপক আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের বিগত চারদশকে শম্ভুক গতির উন্নয়নের পেছনে রয়েছে মেধা পাচারের বিষয়টি। আর এখনও চরম মেধা শূণ্যতায় ভুগছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, চিকিত্সা ও কারিগরি প্রযুক্তির জন্য আমরা এখন বিদেশমুখী। স্বাধীনতার চার দশক পরও শিল্প ও শিক্ষাখাতে আমরা আশানুরূপ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। সামান্য একটা সুই পর্যন্ত আমাদের আমদানী করতে হচ্ছে বিদেশ থেকে। বাংলাদেশের চিকিত্সা ব্যবস্থা এখনো অনেক পিছিয়ে, জটিল রোগের জন্য ভারত, থাইল্যান্ড অথবা সিঙ্গাপুরে দৌড়াতে হয়। অথচ বাংলাদেশের ছেলেরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিকিত্সক হিসেবে সুনাম কুড়াচ্ছেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক সময় বেরিয়েছে সত্যেন সেনের মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ফজলুর রহমানের মতো আর্কিটেক্ট, যিনি নিউইয়ার্কস্থ আমেরিকার সর্বোচ্চ ভবনের নকশা প্রণেতা। ঢাকা মেডিক্যালের ছাত্র খোকন এখন আমেরিকার নামকরা তিনজন চক্ষু চিকিত্সকের মধ্যে অন্যতম। মার্কিন টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ মুজিবুর আর সিরাজুল বাংলাদেশেরই সন্তান।

বাংলাদেশের এ ধরনের অসংখ্য মেধাবী এখন ভিন্ন দেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছেন,্ তাদেরকে আমরা দেশের কাজে লাগাতে পারছি না। এ ধরনের একজন মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী তৈরি করতে দেশের ইনভেস্ট হয় ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। অথচ কর্মজীবনে তারা বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যবহূত হওয়ার পরিবর্তে অর্থের বিনিময়ে বিদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করছেন। মনে রাখতে হবে, বিশ্বে এখন মেধাবীদের কদর সবার উর্ধ্বে। আগে সমরকৌশলে পেশীশক্তির প্রাধান্য দেয়া হতো। কিন্তু এখন বিশ্বে চলছে স্নায়ুযুদ্ধের খেলা। কানাডা, অষ্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ-আমেকািয় মেধাবীদের নাগরিক হিসেবে স্থান দেয়া হয় সবার উর্ধ্বে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রবাসী ভারতীয় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞদের সাহায্য চেয়েছিলেন। তাদেরকে যথাযথভাবে মূল্যায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাঙ্গালোরে প্রতিষ্ঠা করেন কম্পিউটার পল্লী। যার মাধ্যমে ভারত এখন কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

ভারতের আরেক শিল্পপতি বিড়লার উদাহরণ তুলে ধরা প্রয়োজন। তিনি হার্টের চিকিত্সার জন্য গিয়েছিলেন লন্ডনে। চিকিত্সা নিতে গিয়ে দেখলেন ডাক্তারদের অধিকাংশই ভারতীয়। তিনি উপলব্ধি করলেন এসব চিকিত্সা যদি ভারতেই হতো তাহলে টাকা খরচ করে এতো দূরে তাকে চিকিত্সা গ্রহণের জন্য আসতে হতো না। সুস্থ হয়ে তিনি এসব প্রবাসী ভারতীয় চিকিত্সকদের দাওয়াত করলেন এবং কলকাতায় অনুরূপ একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উত্সাহিত করলেন। মি. বিড়লা একটু আশ্বস্ত করলেন যে, লন্ডনের প্রাপ্ত সুবিধা কলকাতাতেই এসব বিচিকত্সকে দেয়া হবে। বিড়লার সেই পদক্ষেপ হয়েছে সফল। এখন পৃথিবীর বহু দেশ থেকে হার্টের রোগীরা চিকিত্সা নিতে আসেন কলকাতার এই বিড়লা হাসপাতালে। এতে বুঝা যায়, কাজের স্বীকৃতি, সুযোগ-সুবিধা, গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করলে আমাদের মেধাবীদেরও দেশে ধরে রাখা এবং তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে সকল ক্ষেত্রে সমৃদ্ধ করা সম্ভব।

এক্ষেত্রে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দেয়া প্রয়োজন। তিনি পাটের জীন আবিষ্কারক প্রয়াত বিজ্ঞানী মাকছুদুল আলমের মতো মেধাবীদের করেছেন যথাযথ মূল্যায়ন ও দিয়েছেন সম্মান। মহাশূন্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উেক্ষপণের মাধ্যমে করেছেন নবদিগন্তের উম্মোচন। রূপপুর পারমানিক কেন্দ্রের কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে দ্রুতগতিতে। অপর সম্ভাবনার দ্বার বঙ্গোপসাগর তথা সমুদ্র সম্পদকে কাজে লাগাতে নিয়েছেন সময়পযোগী ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু এগুলোর সুষ্ঠু তদারকির জন্য দক্ষ ও মেধাবী জনবল প্রয়োজন। তাই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্য মেধাবীদের আহবান জানিয়েছেন দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে। দিয়েছেন তাদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতারও প্রতিশ্রুতি। যা বাস্তবায়িত হলে দেশের উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

 

লেখক : মানবাধিকার সংগঠক

 

সৌজন্যে: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029020309448242