'অষ্টম শ্রেণি থেকে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। আলিম পড়াকালীন সেই সম্পর্ক আরও গভীর হতে থাকে। তার চরিত্র ছিল খুব খারাপ। সিরাজ ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেন। মেয়েদের পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেওয়া ও প্রশ্ন দিয়ে ফাঁদ ফেলতেন সিরাজ। কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে তার সম্পর্কও তৈরি হয়। তারা অধ্যক্ষের কক্ষে নিয়মিত যাতায়াত করত।' নুসরাত হত্যা মামলায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আসামি নূর উদ্দিন আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারা ও পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য দেয়। বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাহাদাত হোসেন পরশ।
সে জানায়, শাহাদাত হোসেন শামীম, হাফেজ আবদুল কাদের, গভর্নিং বডির সহসভাপতি রুহুল আমিন, কাউন্সিলর মাকসুদসহ অনেকে সিরজের কুকর্মের বিষয়গুলো জানত। নূর ও শামীম তাকে সরাসরি সহযোগিতা করে আসছিল। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা তাদের ভয়ে কোনো কথা বলতেন না। অধ্যক্ষ তাদের প্রায়ই আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতেন। পড়ার কোনো খরচ নিতেন না। মাদ্রাসার আয় অধ্যক্ষ ও গভর্নিং বডির সদস্যরা ভাগ করে নিয়ে যেতেন। সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা ঘিরে ছিল দুর্নীতির বড় চক্র।
নূর উদ্দিন জানায়, নুসরাত হত্যা পরিকল্পনার তিন মাস আগেও তার এক বান্ধবীকে অধ্যক্ষ তার কক্ষে ডেকে নিয়ে তার গায়ে হাত দেয়। ওই মেয়ে ও তার মা-বাবা ওই ঘটনার প্রতিবাদ করে। আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিন ও মাকসুদ সেটি ধামাচাপা দেয়। রুহুল আমিন ওই মেয়ের মা-বাবাকে হুমকি দিয়ে তা সমাধান করে ফেলে। ২৭ মার্চ নুসরাতকে নিপীড়ন করার খবর জানার পরপরই মাদ্রাসায় ছুটে যান তার মা। তিনি সঙ্গে নিয়ে আসেন কমিশনার ইয়াসিন ও আবু সুফিয়ানকে। তাদের সঙ্গে ছিল নুসরাতের ছোট ভাই রায়হান। তারা সবাই অধ্যক্ষের কক্ষে ঢোকেন। তখন নুসরাতের মা অধ্যক্ষকে বেত দিয়ে আঘাতের চেষ্টা করেন। আর রায়হান নারকেলের গোদা দিয়ে আঘাতের চেষ্টা করেন সিরাজকে। তখন হুমকি দিয়ে সিরাজ নুসরাতের মাকে বলেন, তোর চার ছেলেমেয়েকে দেখে নেব। নুসরাত কীভাবে পরীক্ষা দেয়, দেখব। পরে নুসরাতকে নিপীড়নের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সিরাজকে গ্রেফতার করা হয়। ২৮ মার্চ নুসরাতের পক্ষে একটি পক্ষ মানববন্ধন করে। অন্যদিকে, সিরাজের পক্ষে কাউন্সিলর মাকসুদ, শামীমসহ আরও অনেকে পাল্টা মানববন্ধনের আয়োজন করে। সিরাজের পক্ষে যে মানববন্ধন হয়, এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয়। সেই মানববন্ধনে অনেকে বক্তব্য দেয়। নূর উদ্দিন ও আবদুল কাদেরকে কাউন্সিলর মাকসুদ, রুহুল আমিন ও শামীম জানায়, মানববন্ধনে কেউ ঝামেলা করলে অথবা বাধা দিলে তাকে যেন মারধর করা হয়। ২৮ মার্চ মানববন্ধন চলাকালে কাউন্সিলর মাকসুদ ও শেখ মামুনের মধ্যে মারামারি হয়। পরে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী উপজেলা নির্বাচনের আগের দিন ৩০ মার্চ মানববন্ধন করা হয়। এতে স্থানীয় জহিরুল ইসলাম, এরশাদ, তারেক, বাদশা, জাবেদ, শাকিলসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিল। তারা সবাই সিরাজের ঘনিষ্ঠ। সকলেই সিরাজের কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিত।
কারাগারে গেলে সিরাজের আচরণের বর্ণনা করে নূর উদ্দিন জানায়, কারাগারে অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি নূরসহ অন্যদের ওপর রাগ করেন। কেন তাকে মুক্তির ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনা করা হচ্ছে না- এ ব্যাপারে জানতে চান। এরপর কারাগার থেকে এসে সবার সঙ্গে আলোচনায় বসে গঠন করা হয় মুক্তি পরিষদ। ৪ এপ্রিল সন্ধ্যার পর মাদ্রাসার পশ্চিম হোস্টেলে বৈঠক হয়। রাত ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত বৈঠক চলে। সেখানে শামীম ও আবদুল কাদের তাদের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। সিরাজের চরিত্র ভালো- এটা প্রচার ও তাকে রক্ষার জন্য সবকিছু করার ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
বৈঠকে শামীম জানায়, নুসরাত তার প্রেম প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তাকে অপমান করেছে। তাই সে নুসরাতের ওপর প্রতিশোধ নিতে চায়। সেখানে সবাই একমত হয়, ৬ এপ্রিল আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষার দিন কৌশলে সাইক্লোন শেল্টার ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হবে নুসরাতকে। সেখানে হত্যার পর তা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হবে।
নূর উদ্দিন আরও জানায়, পরিকল্পনা বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত হয়, শামীম বৈঠকের সব সিদ্ধান্ত কামরুন নাহার মনি ও উম্মে সুলতানা পপিকে জানাবে। নূর উদ্দিন, আবদুল কাদের, ইমরান হোসেন মামুন, ইফতেখার হোসেন রানা, মো. শরীফ ও আফসার মাদ্রাসার গেট নিয়ন্ত্রণ করবে। মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীম সাইক্লোন শেল্টারের নিচে পাহারা দেবে। সেখানে কাউকে ঢুকতে দেবে না তারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ৭টা থেকে সাড়ে ৭টার মধ্যে মাদ্রাসায় চলে যায় নূর উদ্দিনসহ অন্যরা। শামীম, জোবায়ের, জাবেদ, পপি বোরকা ও কেরোসিন নিয়ে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে অবস্থান নেয়। আফসার মাদ্রাসার গেটের ভেতরে এবং নূর উদ্দিন, আবদুল কাদের, ইমরান, রানা, শরীফ মাদ্রাসার বাইরের গেট পাহারা দেয়; যাতে কোনো অভিভাবক ভেতরে ঢুকতে না পারে। নুসরাতের সঙ্গে তার ভাই নোমান মাদ্রাসার গেটে এলে তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। সাইক্লোন শেল্টারের নিচে মহিউদ্দিন শাকিল ও শামীমই পাহারা দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯টা ৩৫ থেকে ৯টা ৪৫ মিনিটের মধ্যে নুসরাতকে বলা হয়, তার বান্ধবী নিশাতকে সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এটা শোনার পর অস্থির হয়ে ছাদের দিকে যান নুসরাত। তার সঙ্গে পপিও ছাদে ওঠে। সেখানে পরিকল্পনা অনুযায়ী নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া হয়। ঘটনার পরপরই শামীম, জোবায়ের, জাবেদ নিচে নেমে পালিয়ে যায়। মনি ও পপি পরীক্ষার হলে প্রবেশ করে। এর কিছু সময় পর নূর উদ্দিন দেখে, গায়ে আগুন নিয়ে নগ্ন শরীরে নুসরাত বাঁচার চেষ্টা করছে। কনস্টেবল রাসেল ও নাইটগার্ড মোস্তফা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন। তারা বস্তা ও পাপোস দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এটা দেখে হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া নূর উদ্দিনও নুসরাতের গায়ে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা চালায়। মাদ্রাসার ছাত্র আবু বকর তার পাঞ্জাবি খুলে নুসরাতের গায়ে দেয়। নূর উদ্দিনসহ অন্যরা সিএনজি অটোরিকশা করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করে।