মৌলিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার আলাদা মন্ত্রণালয় প্রয়োজন

মাছুম বিল্লাহ |

আমাদের দেশে প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত—এটি অবশ্য শুরু হয়েছে সেই ১৯৫৫ সাল থেকে। ১৯৮৩ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা ছিল চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। আর ১৯৭২ সালে গঠিত কুদরাত-এ-খুদা কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা আট বছর করার সুপারিশ করে, যা ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। এর পরবর্তী কমিশনগুলোও প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর করার সুপারিশ করে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে গঠিত কমিশনও প্রাথমিক শিক্ষাকে আট বছর মেয়াদি করার সুপারিশ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের মৌলিক শিক্ষা তাহলে কোন ক্লাস পর্যন্ত? মৌলিক শিক্ষা কি পাঁচ বছর—অর্থাৎ বর্তমানের প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত, নাকি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, নাকি দশম শ্রেণি পর্যন্ত? বিষয়টি ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

ইউনেসকো ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত আবশ্যিক শিক্ষার কথা বলে। তাই অনেক উন্নত দেশে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা। এর সঙ্গে সপ্তম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তর রেখে মৌলিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ হচ্ছে ছয় বছর। বিশ্বের ১৮২টি দেশের মধ্যে ৮৭টিতেই দেখা যায় প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ ছয় বছর। তবে উন্নত বিশ্বের সব কিছুই আমরা অনুসরণ করতে পারব না, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের মতো করে ভাবতে হবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে অনেকটাই বিবেচনায় নিয়ে।

কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন কর্তৃক আট বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করার পেছনে যুক্তি ছিল সর্বজনীন আবশ্যিক শিক্ষার মেয়াদ বাড়ানো, দায়িত্বশীল নাগরিক ও উন্নত ব্যক্তি গঠন এবং অর্থকরী বিদ্যার প্রাথমিক বিষয়গুলো শিক্ষা দেওয়া। তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয় বেশ দূরে দূরে অবস্থিত ছিল বলে নিজ গ্রামে বা কাছাকাছি অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার ব্যবস্থা থাকলে পঞ্চম শ্রেণির পরই ঝরে পড়ার হার হ্রাস পাওয়ার আশাও ছিল। তখন বর্তমানকালের আইসিটি সুবিধা ও গ্লোবালাইজেশনের হাওয়া লাগেনি। এর পরও বর্তমানে আমরা প্রাথমিক শিক্ষাস্তর অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে পারছি না। এটি করতে হলে শুধু সরকারি ৬৪ হাজার ১২২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিটিতেই কমপক্ষে তিনটি শ্রেণিকক্ষ বাড়াতে হবে; যার অর্থ হচ্ছে বিপুল অর্থনৈতিক বিনিয়োগ। এই বিনিয়োগ কি আমরা কোনো বাজেটে রাখছি? রাখিনি।

প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনে, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে প্রাথমিক শিক্ষকদের কোনো প্রতিনিধি নেই। অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের। প্রাথমিক শিক্ষার করুণ দশার অনেক কারণের মধ্যে এটিও একটি। প্রাথমিক শিক্ষার খুঁটিনাটি, সমস্যা, সম্ভাবনা ইত্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খ যাঁরা জানেন, যাঁরা এগুলো সহ্য করে এসেছেন তাঁরা কোনো নীতিনির্ধারণীতে নেই। ফলে যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। আমরা সব সময় বলে এসেছি, প্রাথমিক শিক্ষা হতে হবে সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর সেটি করতে হলে প্রাথমিকে অত্যন্ত মেধাবী ও প্রতিশ্রুতিশীলদের নিয়োগ দিতে হবে। এদিকে কর্তৃপক্ষের নজর আমরা সেভাবে দেখছি না, তারও একটি কারণ শুধু আমলাদের দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার নীতিনির্ধারণী কমিটি তৈরি করা। প্রাথমিকে এমন শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে, যাঁদের মধ্যে একটি অংশ পদোন্নতি পেয়ে পেয়ে ডাইরেক্টর জেনারেল পর্যন্ত হতে পারবেন। এমন ধরনের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা চিন্তাও করা হয় না আর যাঁরা আছেন, তাঁদের সে রকম প্রমোশনের ব্যবস্থাও নেই।

তাই প্রস্তাব করছি, দেশের শিক্ষা পরিচালিত হোক দুটি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। একটি হবে মৌলিক শিক্ষা বা বেসিক এডুকেশন মন্ত্রণালয়, যা দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত হবে। এটি দুই ভাগে বিভক্ত থাকবে—প্রাথমিক শিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা। আর প্রি-প্রাইমারিও থাকবে এ মন্ত্রণালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষাকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করে এবং সপ্তম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা, যাকে আমরা বলব বেসিক এডুকেশন। এ দুটি বিভাগই থাকবে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে, যার নাম হবে মৌলিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

গ্র্যাজুয়েট, অনার্স, মাস্টার্স, এমফিল, পিএইচডি লেভেলের দেখভাল করার জন্য থাকবে উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয় বা হায়ার এডুকেশন মিনিস্ট্রি। দেশের সব ডিগ্রি ও অনার্স কলেজ, যাকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বলে থাকি, সব পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে। এখানে সচিব ছাড়া অন্যান্য পজিশনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ডেপুটেশনে কাজ করবেন।

আর উপরোক্ত কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করার জন্য শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে, যেখানে সব শ্রেণির শিক্ষক, শিক্ষা গবেষক, শিক্ষা নিয়ে যাঁরা আসলেই চিন্তা করেন, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও এই কমিশনের আওতাধীন হবে। প্রচলিত ধারায় যে অনেক কিছু করা যায় না, বিষয়টি নিশ্চয়ই আমরা প্রত্যক্ষ করছি!

 

লেখক : ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ ও রাজউক কলেজ শিক্ষক

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032558441162109