ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

ময়মনসিংহ প্রতিনিধি |

ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ড. গাজী হাসান কামালের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিজ পরিবারের সদস্যদের বোর্ডে নিয়োগ, বোর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তদের বাদ দিয়ে ঘুষের বিনিময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি, শ্রেণিশাখা খোলার অনুমতির ব্যবস্থা করা, বিভিন্ন উদযাপন ব্যয়ের সিংহভাগ নিজের পকেটে নেয়াসহ নানা অভিযোগ তুলেছেন বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া চেয়ারম্যানের ভাইদের বিরুদ্ধেও বোর্ডের বিভিন্ন কাজে হস্তক্ষেপ এবং কর্মকর্তাদের হুমকি-ধামকি দেয়ার অভিযোগ আছে। চেয়ারম্যানের এক ভাইয়ের আবদার না শোনায় বোর্ডের এক কর্মকর্তার বাসায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এসব নিয়ে ময়মনসিংহ বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান ড. গাজী হাসান কামাল। তিন বছর বোর্ড চেয়ারম্যান থাকার বিধান থাকলেও তিনি সাড়ে চার বছর ধরে এ পদে আছেন। বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অভিযোগ, বিভিন্নভাবে ঊর্ধ্বতনদের ম্যানেজ করে তিনি এ পদে আছেন। 

যদিও সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চেয়ারম্যান ড. গাজী হাসান কামাল।  এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল রোবার চেয়ারম্যান দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেছেন, কয়েকজন কর্মকর্তা দুর্নীতির চেষ্টা চালিয়েছেন এবং এরজন্য তাদের নিবৃত্ত করায় তারা ভিত্তিহীন অভিযোগ ছড়াচ্ছেন।

বোর্ডের কয়েকজন কর্মকর্তার অভিযোগ, চেয়ারম্যান হওয়ার পর নিজের পরিবারের কয়েকজনকে বোর্ডে নিয়োগ দিয়েছেন গাজী হাসান কামাল। তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার পর বড় ভাই গাজী হাসান ফারুকের ছেলে রুবায়েত হাসান ও আরেক ভাই গাজী হাসান শহীদের স্ত্রী দোলনা আক্তারকে বোর্ডের অফিস সহকারী পদে নিয়োগ দিয়েছেন। চেয়ারম্যানের তিন ভাই গাজী হাসান ফারুক, গাজী হাসান শহীদ ও গাজী হাসান বাবু  প্রতিদিন বোর্ডের বিভিন্ন কাজের তদবির করেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ আবদার না রাখলে চেয়ারম্যানের ভাই গাজী হাসান শহীদ নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বোর্ডের কর্মকর্তাদের প্রায়ই ফোন করে গালাগালি করেন। বোর্ডের কাজে দালালি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। এ নিয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালী থানায় জিডিও হয়েছে। চেয়ারম্যানের ছোট ভাই গাজী হাসান বাবু নিজের চাহিদামতো কাজ না হওয়ায় বোর্ডের কর্মকর্তাদের বাসায়ও হামলা চালিয়েছেন বলে জানান কর্মকর্তারা। তবে তারা এ বিষয়ে অনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে চাচ্ছেন না। বোর্ডের একটি সূত্র দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানিয়েছে, একটি স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিয়ে আবদার না রাখায় বোর্ডের এক কর্মকর্তারা বাসায় হামলা চালিয়েছেন। তবে, ওই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি অনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অভিযোগ আছে, বিভিন্ন উদযাপন কমিটির অর্থ বরাদ্দ থেকে সিংহভাগ অর্থ নিজে নিয়ে নেন। কেউ প্রতিবাদ করলে ভয়ভীতি দেখান এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন। এ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

বোর্ডের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, স্থানীয় এবং জাতীয় পর্যায়ের সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহলকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন যার ফলে বোর্ডের দুর্নীতির প্রকৃত চিত্র বের হয়ে আসে না। এভাবে বিভিন্ন মহলকে উৎকোচ দিয়ে করে প্রায় সাড়ে চার বছর যাবৎ চেয়ারম্যান হিসেবে বহাল তবিয়তে আছেন। গানম্যান সাইফুল ইসলামের সাথে চেয়ারম্যানের  যোগাযোগ আছে বলে জানা যায়। গানম্যান সাইফুলের আপন দুই ভাতিজা শাহীন ও তারেককে বোর্ডে চাকরি দিয়েছেন।

বোর্ডের কর্মকর্তাদের অভিযোগ, চেয়ারম্যানের দুর্নীতির আরেক ক্ষেত্র হচ্ছে বোর্ডের কলেজ পরিদর্শন ও বিদ্যালয় পরিদর্শন বিভাগ। বোর্ডের আওতাধীন কলেজ ও বিদ্যালয়গুলোতে প্রাথমিক পাঠদানের অনুমতি, স্বীকৃতি, শ্রেণি-শাখা খোলা ইত্যাদি কাজের জন্য পরিদর্শন করার প্রয়োজন পড়ে, কলেজ ও বিদ্যালয় শাখার পরিদর্শন কর্মকর্তাদের কাজ। কলেজ-বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে গেলে কর্মকর্তাদের সম্মানার্থে কিছু সম্মানী দেওয়ার অবৈধ রেওয়াজ আছে। কিন্তু বোর্ডের চেয়ারম্যান বোর্ডের সিংহভাগ পরিদর্শন তিনি নিজে অথবা তার অনুগত বোর্ডের পরীক্ষা শাখার কর্মকর্তা সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সাখাওয়াত হোসেনকে দিয়ে করিয়ে থাকেন। এ সংক্রান্ত সব আবেদন বিদ্যালয় শাখা ও কলেজ শাখায় জমা নেয়ার প্রচলন থাকলেও তা না করে সব আবেদন চেয়ারম্যানের পিএ ফয়সল হোসেন গ্রহণ করেন। পরে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের সাথে যোগাযোগ করে পরিদর্শন কাজ সম্পন্ন করে থাকে। এ কাজে কলেজ পরিদর্শক ও বিদ্যালয় পরিদর্শককে প্রায় অন্ধকারেই রাখে বলা যায়। সাখাওয়াত হোসেন পরীক্ষা শাখার সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক হলেও তাকে বিদ্যালয় শাখায় সংযুক্ত করা হয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেছেন, ‘ঘন ঘন পরিদর্শন, যত পরিদর্শন তত টাকা। বেহুদা পরিদর্শন বলা যায়।’ 

দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে যা বললেন চেয়ারম্যান :

পরিবারের সদস্যদের নিয়োগের অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে চেয়ারম্যান গাজী হাসান কামাল দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, বোর্ডের জনবল কাঠামো এখনো অনুমোদন হয়নি। তাই আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ১৪ জন কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তাদের সবার নিয়োগ অস্থায়ী। তাদের মধ্যে আমার পরিবারের সদস্য যারা তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই নিয়োগ পেয়েছেন। 

বোর্ডে পরিবারের সদস্যদের প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আমার ভাই বা পরিবারের সদস্যরা বোর্ডে কোনো প্রভাব বিস্তার করেননি। তবে যে অভিযোগটি উঠেছে সেই একজন কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে। তিন বছর এক কর্মকর্তা দুর্নীতির চেষ্টা করছিলো। তখন আমার একভাইয়ের নজরে বিষয়টি আসে। তিনি ওই কর্মকর্তাকে মৌখিকভাবে সতর্ক করেন। পরে বোর্ড মিটিং করে আমি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সতর্ক করেছি। এটি তিন বছর আগের ঘটনা। আমার পরিবারের কোনো সদস্য বোর্ডে প্রভাব বিস্তার করেন না।

স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চেয়ারম্যান আরও বলেন, কয়েকজন কর্মকর্তা দুর্নীতির চেষ্টা করায় তাদের নিবৃত্ত করা হয়েছে। স্কুল পরিদর্শক ও উপবিদ্যালয় পরিদর্শকের বিরুদ্ধে কিছু অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি। স্থানীয় এমপি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। এজন্য বোর্ডের আইনে দেয়া ক্ষমতা বলে আমি পরিদর্শন শাখার কাজে কিছু পরিবর্তন এনেছি।  সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক সাখাওয়াত হোসেনকে কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। যদিও পরিদর্শনের সিংহভাগ কাজ করেন স্কুল পরিদর্শক ও উপবিদ্যালয় পরিদর্শক। আপনারা বোর্ডে এসে দেখেন। গত মাসে ১০টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন হলে সাখাওয়াত করেছে দুইটি, আর বাকিগুলো পরিদর্শন শাখার কর্মকর্তারাই করেন। 

যদিও পরিদর্শনের জন্য কর্মকর্তাদের খুশি করতে কিছু দেয়ার রেওয়াজের কথা দৈনিক আমাদের বার্তার পক্ষ থেকে করা এক প্রশ্নের জবাবে স্বীকার করেছেন বোর্ড চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তাদের নিজস্ব পরিবহন না থাকায় অনেক সময় আসা যাওয়ার জন্য কিছু হয়তো প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ খুশি হয়ে দেয়।’

চেয়ারম্যান আরও দাবি করেন, কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এমপি  এবং শিক্ষকরা অভিযোগ তুলেছিলেন। তাদের নিবৃত্ত করতে আমি ব্যবস্থা নিয়েছি। এজন্য তারা আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। তিনি সাংবাদিকদের বোর্ডে গিয়ে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার পরমর্শ দেন। 

সাড়ে ৪ বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে থাকার অভিযোগ নিয়ে গাজী হাসান কামাল বলেন, আমি নিজে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি মহোদয়কে বলে এসেছি। আমি মন্ত্রী স্যারকে বলেছি আমার তো চার বছর হলো আমাকে এবার সরিয়ে দেন। যদি চেয়ারম্যান পদ আকরে ধরে থাকার ইচ্ছা থাকতো আমি উনাকে এটা বলতামই না।

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে সয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল  SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027220249176025