যশোর শিক্ষা বোর্ডে দরপত্র ছাড়াই কেনাকাটা, অধিকাংশই অস্তিত্বহীন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

যশোর শহরের জামে মসজিদ লেনের সাহিদ কম্পিউটার। এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রিন্টারে কালি সরবরাহের ৬০টি টোনার কিনেছে যশোর শিক্ষা বোর্ড। সেগুলোর মোট দাম ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি টোনারের দাম চার হাজার টাকা।

এইচপি ১১০২ মডেলের প্রিন্টারের ওই টোনারের নম্বর ৮৫-এ। যশোরে কম্পিউটার সামগ্রীর সবচেয়ে বড় বিপণিবিতান জেস টাওয়ারের কম্পিউটার সিটি। সেখানে ৮৫-এ নম্বরের আসল টোনারের বাজারমূল্য পাঁচ হাজার টাকা। সাহিদ কম্পিউটার তা চার হাজার টাকায় সরবরাহ করল কীভাবে? জানতে চাইলে দোকানটির মালিক কে এম রওশন সাহিদ বললেন, ‘আমার দোকানে শুধু গ্রাফিকসের কাজ হয়। আমরা টোনার বিক্রি করি না।’ শিক্ষা বোর্ডে সরবরাহ করা তাঁর দোকানের প্যাড দেখালে তিনি বলেন, ‘এই প্যাড আমার নয়। কেউ হয়তো নকল প্যাড তৈরি করে শিক্ষা বোর্ডে জমা দিয়েছে।’ মঙ্গলবার (২৭ আগস্ট) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন মনিরুল ইসলাম।

শুধু এই ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা নয়; যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দরপত্র ছাড়াই ২ কোটি ২৬ লাখ টাকার কম্পিউটার সামগ্রী কিনেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ক্রয়বিধি উপেক্ষা করায় স্থানীয় ও রাজস্ব অডিট অধিদপ্তরের নিরীক্ষা দল আপত্তি দিয়েছে।

জানতে চাইলে যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল আলীম বলেন, বোর্ডের পরীক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য ওই মালামাল কেনা হয়েছে। অনেক সময় দরপত্রের মাধ্যমে কিনতে বেশি সময় লাগে। তাই জরুরি প্রয়োজনে কোটেশনের মাধ্যমে সেগুলো সংগ্রহ করে চাহিদা মেটানো হয়েছে। অডিট আপত্তির বিষয়ে তিনি বলেন, এ–সংক্রান্ত জবাব দিয়েছেন তাঁরা।

সরকারের অর্থ বিভাগের আর্থিক ক্ষমতা (অনুন্নয়ন) সংশোধন আদেশ অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে প্রতি ক্ষেত্রে এককালীন তিন লাখ টাকা পর্যন্ত দরপত্র বাদে কোটেশনের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী কেনা যাবে। তবে তা কোনোক্রমেই বছরে ১৫ লাখ টাকার বেশি হবে না। যশোর শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এই ক্রয়বিধি লঙ্ঘন করেছে।

স্থানীয় ও রাজস্ব অধিদপ্তর সেগুনবাগিচা কার্যালয়ের অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত দুটি আপত্তি গত ১ এপ্রিল যশোর শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়েছে, বোর্ডের ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ক্যাশ বই, খরচের বিবরণী ও বিল-ভাউচার নিরীক্ষা করে দেখেছেন তাঁরা। সে মোতাবেক, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতি এড়িয়ে অনিয়মিতভাবে কোটেশন প্রদানের অনুরোধসংবলিত বিজ্ঞপ্তি (আরএফকিউ) অনুসরণ করে কম্পিউটার সামগ্রী কেনা হয়েছে। এর মূল্য ২ কোটি ২৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষমতা (অনুন্নয়ন) সংশোধন আদেশ উপেক্ষা করা হয়েছে। এ বিষয়ে বোর্ডকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয় আপত্তিপত্রে।

এ বিষয়ে কর্মকর্তা মফিজুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা বোর্ড থেকে অডিট আপত্তির বিষয়ে ব্যাখ্যা পাওয়া গেছে। কিন্তু এখনো অডিট আপত্তির নিষ্পত্তি হয়নি।

পরতে পরতে অনিয়ম

২ কোটি ২৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকায় প্রিন্টারের টোনারের পাশাপাশি কেনা হয়েছে কম্পিউটার, সিপিইউ, আইপিএস, টেলিফোন সেট, স্ক্যানার যন্ত্র, টেলিভিশন, কম্পিউটারের প্রিন্টার, ইন্টারনেট সংযোগের কেব্‌ল ইত্যাদি। এর মধ্যে টোনার কিনতেই ব্যয় হয়েছে ৫৪ লাখ টাকা। শুধু টোনার কেনার তথ্য পেতে এই প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে বোর্ড কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। আবেদনে জানতে চাওয়া হয়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বোর্ডে কত টাকায় কম্পিউটারের কোন মডেলের কতগুলো টোনার কেনা হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান থেকে টোনার কেনা হয়েছে, তার ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর।

আবেদনের ১৮ কার্যদিবস পরে আংশিক তথ্য সরবরাহ করে শিক্ষা বোর্ড। তাতে বলা হয়, মোট পাঁচটি প্রতিষ্ঠান থেকে টোনার কেনা হয়েছে। চারটি যশোরের ও একটি খুলনার প্রতিষ্ঠান। যশোরের চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তিনটির কার্যালয়ের একই ঠিকানা লেখা হয়: ‘৫/বি অম্বিকা বসু লেন, যশোর’। ওই ঠিকানায় গিয়ে ‘মডার্ন টেকনোলজি বিডি’ ও ‘টেকনোলজিসি বিডি’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই পাওয়া যায়নি। অপর প্রতিষ্ঠান আইটি হাউসের সাইনবোর্ড আছে। তবে কার্যালয় বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় কয়েকজন বলেন, এই কার্যালয় নিয়মিত খোলা হয় না।

সাইনবোর্ডে থাকা মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলে একজন আতাউর রহমান পরিচয় দেন। বলেন, তিনি আইটি হাউসের ব্যবস্থাপক। শিক্ষা বোর্ডে তাঁরা টোনার সরবরাহ করেন। তবে কত দামে ওই টোনার দেয়া হয়েছে, তা তিনি বলতে পারেননি।

এ ছাড়া শিক্ষা বোর্ডের দেয়া তথ্যে, নিও-ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল নামের এক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ‘৬, পুরাতন যশোর রোড, যশোর’। বাস্তবে ওই নামে যশোরে কোনো সড়কই নেই। আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থেকে টোনার কেনার তথ্য মিলেছে অডিট আপত্তি থেকে। এর মধ্যে রয়েছে যশোর শহরের গাড়িখানা ‘সড়কের মেসার্স আবদুস সালাম লস্কর’ ও ‘আব্দুস সালাম লস্কর এন্টারপ্রাইজ’। কিন্তু গাড়িখানা সড়কে গিয়ে ওই দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় লোকজনের কেউই এমন নামে কোনো প্রতিষ্ঠান চেনেন না।

তথ্য অধিকার আইনে দেয়া বোর্ডের নথিতে এ দুটি প্রতিষ্ঠান থেকে টোনার কেনার কথা গোপন করা হয়। একইভাবে সাহিদ কম্পিউটার থেকে টোনার কেনার বিষয়েও কোনো তথ্য দেয়া হয়নি। এসব তথ্য কেন গোপন করা হলো? জানতে চাইলে নথিতে সই করা বোর্ডের সচিব এ এম এইচ আলী আর রেজা বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। অফিস থেকে আমার কাছে যে তথ্য বিবরণীপত্র সরবরাহ করা হয়েছে, আমি সেখানে স্বাক্ষর করেছি মাত্র। এর বেশি কিছু আমি জানি না।’

অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য কেনার কার্যাদেশের বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম বলেন, ‘বোর্ডের কমন সার্ভিস শাখা, প্রধান মূল্যায়ন কর্মকর্তা, সচিবসহ বিভিন্ন কর্মকর্তার মাধ্যমে ক্রয়ের নথি আমার কাছে আসে। বাজার যাচাই করে সর্বনিম্ন দরদাতার কাছ থেকে পণ্য কেনার জন্য ক্রয় কমিটিকে আদেশ দেয়া হয়। এর মধ্যে যদি কোনো অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ক্রয়ের ঘটনা থাকে, তাহলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0046038627624512