যেসব অভিযোগে বহিষ্কার হলেন যুবলীগ নেতা আনিস

নিজস্ব প্রতিবেদক |

দুর্নীতি-মাদক ও ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু হওয়ার পর আত্মগোপনে যাওয়া যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান আনিসকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ আতিয়ার রহমান দীপু।

তিন ঘণ্টার রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে তিনি বলেন, কাজী আনিসের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছে, প্রেসিডিয়াম সদস্যরা একমত হয়েছেন কাজী আনিসকে বহিষ্কার করার জন্য। সেই আলোকে কাজী আনিসকে আমরা বহিষ্কার করেছি। ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক হিসেবে কাউকে দায়িত্ব দেয়া হবে কি না- সে সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান দীপু।

তিনি যুবলীগ অফিসের পিয়ন থেকে কেন্দ্রীয় নেতা বনে যান কাজী আনিস। দুর্নীতি-মাদক-ক্যাসিনোবিরোধী শুদ্ধি অভিযান শুরু হলে তিনি আড়ালে চলে যান। প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা কাজী আনিসের অবস্থান নিয়ে সৃষ্টি হয় ধোঁয়াশার। কেউ বলছেন কাজী আনিস দেশত্যাগ করেছেন; কেউ বলছেন আত্মগোপনে আছেন।

কি কারণে আনিসকে বহিষ্কার করা হয়েছে জানতে চাইলে যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক এ বি এম আমজাদ হোসেন বলেন, ‘কাজী আনিস বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের দফতর সম্পাদক। তার দুর্নীতির কথা আমরা পত্র পত্রিকায় দেখেছি এবং অর্থনৈতিক তসরুফের কারণে তাকে যুবলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।’

যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন আদায় এবং সংগঠনের বিভিন্ন কমিটিতে পদ-বাণিজ্য করে বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।

গত ২০ দিন ধরে কাজী আনিস আত্মগোপনে আছেন। তিনি দলীয় কার্যালয়ে যাচ্ছেন না, বাড়িতেও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরদার মোহাম্মদ আলী মিন্টু জানানন, আনিস যুবলীগের কমিটি বিক্রি করে, চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন নিয়ে অবৈধ ভাবে বিপুল পরিমাণে সম্পদ বানিয়েছে। এর ভয়ে এখন সে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

যুবলীগ নেতাদের সূত্রে জানা গেছে, কাজী আনিস কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে যোগ দেন ২০০৫ সালে। বেতন ছিল মাসে ৫ হাজার টাকা। সাত বছর পর বনে যান কেন্দ্রীয় যুবলীগের দফতর সম্পাদক। যুবলীগের সবশেষ কমিটিতে তাকে এই গুরুত্বপূর্ণ পদ দেন সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব।

কাজী আনিস আঙুল ফুলে কলাগাছ। তিনি এখন একাধিক গাড়ি-বাড়ি, ফ্ল্যাট ও জমির মালিক। আত্মগোপনে যাওয়ার আগে কোটিপতি আনিস যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক ছাড়া কাউকে পরোয়া করতেন না। তার বেপরোয়া মনোভাবে যুবলীগ নেতাদের অনেকেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে কোণঠাসা।

২০০৫ সালে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যখন আনিসের চাকরি হয়, তখন তিনি নেতাদের হুট ফরমায়েশ শোনার পাশাপাশি কম্পিউটার অপারেটরের কাজও করতেন। এই সুবাদে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি কার্যালয়ে আসা তৃণমূল নেতাদের সঙ্গেও সখ্য হয় তার। সময়ের ব্যবধানে প্রযুক্তিকে পিছিয়ে থাকা নেতাদের নজরেও চলে আসেন আনিস।

কেন্দ্রীয় যুবলীগ সারা দেশে যেসব কমিটি দিত, সেগুলো কম্পিউটারে টাইপ করে দিতেন আনিস। টাইপ করতে গিয়ে কোন জেলায় কে সভাপতি কে সম্পাদক তা নখদর্পণে চলে আসে আনিসের। মুখস্থ বলে দিতে পারতেন যেকোনো কমিটির নেতার নাম। এসব কারণেই চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠ হয়ে যান তিনি। আবার জেলাপর্যায়ের নেতারাও কমিটির বিষয়ে কেন্দ্রের তথ্য বা সিদ্ধান্ত জানতে তাকে ফোন করতেন। এভাবে জেলা নেতাদের সঙ্গেও তার সখ্য হয়ে যায়।

২০১২ সালে যুবলীগের কমিটি হলে আনিস পেয়ে যান উপদফতর সম্পাদকের পদ। শীর্ষ নেতার আশীর্বাদ থাকায় ছয় মাস পর খালি থাকা দফতর সম্পাদক পদে পদোন্নতি পেয়ে যান আনিস।

কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আনিসকে সবাই ‘ক্যাশিয়ার’ বলেই চেনে। তবে গত এক যুগে তিনি শতকোটি টাকার মালিক বনে গেছেন। কিছু যুবলীগ নেতার সব ধরনের অপকর্মের সঙ্গী এই আনিস।

ধানমণ্ডি ১৫ নম্বর সড়কে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে আনিসের। তবে ওই ফ্ল্যাটে তিনি থাকেন না। বর্তমানে রাজধানীর ধানমণ্ডির ১০/এ সড়কের একটি বাড়ির ফ্ল্যাটে থাকেন কাজী আনিস। ওই ফ্ল্যাটটিও তার নিজের।

শুধু তাই নয়, গোপালগঞ্জে আনিসের রয়েছে বিপুল স্থাবর সম্পত্তি। আগে পাঁচ-ছয় বিঘা জমি ছিল তাদের। গত চার বছরে কয়েক বিঘা জমি কিনেছেন। বাড়ি করেছেন, পেট্রলপাম্প এবং তার পাশের জমি কিনেছেন। এর মধ্যে পেট্রলপাম্পটি কিনতে কোটি টাকা লেগেছে আনিসের। পাশেই ৫ একর জমি আছে তার কেনা। এ ছাড়া ঢাকায় আনিসের তিনটি বাড়ি আছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদাবাজি, দরপত্র থেকে কমিশন ও যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদবাণিজ্য করেই বিত্তবৈভব গড়ে তুলেছেন কাজী আনিস। যুবলীগ নেতারা জানান, আনিসের দাপটে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে টেকা দায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতারা অভিযোগ করেন, আনিসের বিরুদ্ধে কথা বলে টেকা কঠিন। বিভিন্ন ইউনিটে বছরের পর বছর সম্মেলন না করে আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে চালানো হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে এসব আহ্বায়ক কমিটি বানানো ও দীর্ঘদিন বহাল থাকার সুযোগ করে দিচ্ছেন আনিস। আনিসের দাপটে পুরনো অনেক নেতা যুবলীগে নিষ্ক্রিয় হয়ে আছেন।

নেতাকর্মীরা জানান, জিকে শামীম, খালেদসহ কয়েকজনের সঙ্গে সিন্ডিকেট গড়েন আনিস। তার সিন্ডিকেট চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ক্লাবে জুয়ার আসর চালানোসহ সব অপকর্মে জড়িত। যুবলীগে আনিসুর ‘ক্যাশিয়ার’ নামেই পরিচিত। চাঁদার টাকা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন মহলে পৌঁছানোর কাজ করেন তিনি। এক শীর্ষ নেতা ছাড়া সবাই তাকে সমীহ করেন। আনিসুরের কারণে ত্যাগী ও সৎ যুবলীগ নেতারা শীর্ষ নেতাদের কাছেও ভিড়তে পারেন না।

যুবলীগের ৭ম কংগ্রেস উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংগঠনটির প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক শুরু হয় বেলা ১১টায়। এ বৈঠকে যোগ দেননি চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে কাজী আনিসের বহিষ্কার অন্যতম।

জাতীয় কংগ্রেসের আগে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকে সংগঠনটির অধিকাংশ প্রেসিডিয়াম সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন না যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে গ্রেফতার যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে তার সখ্যের তথ্য উঠে আসে। তার মদদে রাজধানীতে অনেক যুবলীগ নেতা ক্যাসিনো ব্যবসা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া তার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞাও জারি করা হয়। তলব করা হয়েছে ব্যাংক হিসাব। এর পর থেকে রাজনীতি থেকে অনেকটাই আড়ালে চলে যান ওমর ফারুক। তার বিষয়ে আজকের সভায় আলোচনা হয়। সভাশেষে যুবলীগ নেতারা বলেন, যুবলীগ চেয়ারম্যানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সভায় সভাপতিত্ব করেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ। উপস্থিত ছিলেন- প্রেসিডিয়াম সদস্য শহীদ সেরনিয়াবাত, শেখ শামসুল আবেদীন, আলতাব হোসেন বাচ্চু, মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, মজিবুর রহমান চৌধুরী, মো. ফারুক হোসেন, মাহবুবুর রহমান হিরণ, আবদুস সাত্তার মাসুদ, মো. আতাউর রহমান, অ্যাডভোকেট বেলাল হোসাইন, আবুল বাশার, মোহাম্মদ আলী খোকন, অধ্যাপক এবিএম আমজাদ হোসেন, আনোয়ারুল ইসলাম, ইঞ্জিনিয়ার নিখিল গুহ, শাহজাহান ভূঁইয়া মাখন, ডা. মোখলেছুজ্জামান হিরু, শেখ আতিয়ার রহমান দীপু প্রমুখ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028281211853027