যে কলেজ কেরাণির হিসাবে অবৈধ ২৪ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

জিপিএ ফাইভ কিনে এবং ঢাকা শিক্ষাবোর্ডকে ম্যানেজ করে পাবলিক পরীক্ষায় ভালো ফল দেখানোয় অভিযুক্ত একটি কলেজের করণিকের ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ২৪ কোটি ২৯ লাখ টাকার বেশি অর্থ। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, কোন কলেজের করণিক তিনি, এত টাকা কীভাবে আসল, আয়ের উৎসই বা কী?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অবস্থান রাজধানীর মাতুয়াইলে। ওই করণিক অর্থাৎ হিসাবরক্ষক হলেন ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের আকরাম মিয়া। তার ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে পাওয়া গেছে ওই টাকা। ‘কলেজের বিভিন্ন খাতের আয়ের টাকা যাতে বেহাত না হয় সেজন্য তার হিসাবে ওই টাকা রেখেছেন কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা’ অনুসন্ধানে এমন তথ্য পাওয়া গেলেও তা ‘যুক্তিযুক্ত নয়’ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের অভিযোগ, কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের হাত ঘুরে ওই টাকা আকরাম মিয়ার হিসাবে স্থানান্তরিত হয়েছে।

আকরাম মিয়ার নামে বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখায় ২০২২ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি স্থায়ী হিসাবে (এফডিআর) জমা আছে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৪ টাকা। সামান্য একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার হিসাবে অস্বাভাবিক এমন লেনদেনের তথ্য ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে পৌঁছেছে

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, আকরাম মিয়ার নামে বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখায় ২০২২ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি স্থায়ী হিসাবে (এফডিআর) জমা আছে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৪ টাকা। সামান্য একজন করণিকের হিসাবে অস্বাভাবিক এমন লেনদেনের তথ্য ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে পৌঁছেছে। দুদকের অনুসন্ধানেও বিষয়টি অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। এ কারণে ওই হিসাবটি অবরুদ্ধকরণের (ফ্রিজ) সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

দুদক কমিশন থেকে নেওয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আদালতের অনুমতি চেয়ে চিঠিও দিয়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা ও সহকারী পরিচালক শারিকা ইসলাম। গত ১৬ আগস্ট মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দেওয়া চিঠির একটি কপি সংরক্ষিত আছে।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের হিসাবরক্ষক আকরাম মিয়ার সঙ্গে। টাকার কথা স্বীকার করলেও তিনি ওই টাকার মালিক নন বলে জানান। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবুর রহমানের নির্দেশে ওই টাকা তার হিসাবে রাখা হয়েছে— এমন দাবি করেন তিনি।

আকরাম মিয়া বলেন, ‘দুদকের অনুসন্ধানের বিষয়টি জানা নেই। কলেজ ড্রেসের কাপড় বিক্রিসহ প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আয়ের টাকা আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রাখা হয়েছে। কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবুর রহমান স্যার ওই টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবেন, তাই আমার অ্যাকাউন্টে রেখেছেন।’

একটি প্রতিষ্ঠানের টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে কেন রাখা হলো— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা একেকজন একেক মনা। তাদের নামে টাকাটা যদি রাখা হতো তাহলে হয়তো ওই টাকার অপব্যবহার বা তসরুপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হয়তো স্যারের পূরণ হতো না। সে কারণে স্যার আমার অ্যাকাউন্টে টাকাটা রেখেছেন।’

‘আসলে আমি তো ওভাবে বুঝিনি। ব্যাংক ম্যানেজার আমাকে সই দিতে বলেছেন, আমি সই দিয়েছি। অ্যাকাউন্টের নমিনি কে, সেটাও আমার জানা নেই। তাছাড়া টাকাটা সম্পূর্ণ বৈধ বলেই জানি।’

এ বিষয়ে জানতে কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার নির্দেশে ওই টাকা প্রধান হিসাবরক্ষক আকরাম মিয়ার হিসাবে রাখা হয়েছে— বিষয়টি সরাসরি তিনি অস্বীকার করেন। তাহলে প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মচারীর হিসাবে এত টাকা কীভাবে এলো— জানতে চাইলে মাহবুবুর রহমান মোল্লা বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই।  মাহবুবুর রহমান মোল্লার বিরুদ্ধে জামাতপন্থী শিক্ষা সাংবাদিকদের সঙ্গে সখ্য এবং অর্থ সাহায্য দেওয়ার অভিযোগ পুরনো। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় গণশিক্ষা সম্পাদক বরখাস্ত অধ্যক্ষ মো. সেলিম ভুইয়ার পিতার নামেও একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে।  

প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা একেকজন একেক মনা। তাদের নামে টাকাটা যদি রাখা হতো তাহলে হয়তো ওই টাকার অপব্যবহার বা তসরুপ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হয়তো স্যারের পূরণ হতো না। সে কারণে স্যার আমার অ্যাকাউন্টে টাকাটা রেখেছেন আকরাম মিয়া, হিসাবরক্ষক, ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ

এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান-সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য নেওয়া চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

আদালতে পাঠানো দুদকের চিঠিতে যা আছে

মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বরাবর দুদকের পাঠানো চিঠিতে ওই হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার বিষয়ে আবেদন জানানো হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘অনুসন্ধানকালে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই শেষে দেখা যায়, ড. মাহবুবুর রহমান কলেজের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. আকরাম মিয়ার নামে বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখায় ২০২২ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত পাঁচটি এফডিআর হিসাব খোলা হয়। হিসাবগুলো হলো- ৬১১৮-০১-০০১০৬৩৭, ৬১১৮-০১-০০১০৬৪২, ৬১১৮-০১-০০১০৬৫৮, ৬১১৮-০১-০০১০৬৬৩ ও ৬১১৮-০১ ০০১০৬৭৯। হিসাবগুলোতে বর্তমানে ২৪ কোটি ২৯ লাখ ৮৯ হাজার ৫২৪ টাকা স্থিতি রয়েছে। কলেজের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নামে ব্যাংকে ওই টাকার এফডিআর হিসাব থাকার বিষয়টি অস্বাভাবিক এবং অভিযোগ সংশ্লিষ্ট অপরাধ সংগঠনের মাধ্যমে অর্জিত।’

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘গোপন সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত টাকা নগদে উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন। বর্ণিত টাকা অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা বেহাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অনুসন্ধান নিষ্পত্তির পূর্বে বর্ণিত হিসাবসমূহে জমাকৃত টাকা হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির কারণ রয়েছে। সেহেতু উল্লিখিত ব্যাংক হিসাবসমূহ অবিলম্বে ফ্রিজ করা আবশ্যক।’

একই সঙ্গে চিঠিতে আদালতের ফ্রিজ আদেশ কার্যকরের জন্য বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখার ব্যবস্থাপককে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

অন্যদিকে, কলেজের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ও ভাতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বেসিক ব্যাংকের মাতুয়াইল শাখায় আকরাম মিয়ার নামে অপর একটি এসএনডি হিসাব অবরুদ্ধকরণের (ফ্রিজ) বাইরে রাখার অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে। ওই ব্যাংক হিসাবে এক কোটি ২১ লাখ ২৬ হাজার ৬৪২ টাকা স্থিতি রয়েছে বলে জানা যায়।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘গোপন সূত্রে জানা যায়, অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উক্ত টাকা নগদে উত্তোলন করে অন্যত্র স্থানান্তর করার চেষ্টা করছেন। বর্ণিত টাকা অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করা না হলে তা বেহাত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। অনুসন্ধান নিষ্পত্তির পূর্বে বর্ণিত হিসাবসমূহে জমাকৃত টাকা হস্তান্তর বা স্থানান্তর হয়ে গেলে রাষ্ট্রের সমূহ ক্ষতির কারণ রয়েছে। সেহেতু উল্লিখিত ব্যাংক হিসাবসমূহ অবিলম্বে ফ্রিজ করা আবশ্যক’
কে এই  মাহবুবুর রহমান

ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা মাহবুবুর রহমানের আর একটি পরিচয় রয়েছে। তিনি ডেমরার সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির বিভিন্ন অভিযোগ দুদকে জমা হয়েছে বলেও জানা গেছে। 

দুর্নীতির অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- নামের সঙ্গে ভুয়া ডক্টরেট ডিগ্রি যোগ করা, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজের মেয়ে, আপন ভাই ও শ্যালকসহ আত্মীয়দের চাকরি দেওয়া, বিভিন্ন কৌশলে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা আত্মসাৎ, ভর্তি বাণিজ্য, অবৈধ কোচিং বাণিজ্য, ফল কারচুপি, জিপিএ ফাইভ কেনা এবং অতিরিক্ত রেজিস্ট্রেশন ফি আদায়। এছাড়া আমিরুল আলম পলাশ নামের ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে সদ্য বিদায় হওয়া পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে নানা অবৈধ সুবিধা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি - dainik shiksha এমপিওভুক্তির নতুন আদেশ জারি জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha জবিতে ভর্তির প্রাথমিক আবেদন শুরু ১ ডিসেম্বর শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় বদলি কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন - dainik shiksha কুবির বঙ্গবন্ধু হল ও শেখ হাসিনা হলের নাম পরিবর্তন ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি - dainik shiksha ডিআইএ পরিচালক কাজী কাইয়ুম শিশিরকে বদলি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আন্দোলনে শহীদদের স্মরণসভা সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ - dainik shiksha সরকারি কলেজ প্রদর্শকদের পদোন্নতির খসড়া প্রকাশ এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১১ হাজার শিক্ষক পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন - dainik shiksha পঞ্চমে ফিরছে বৃত্তি পরীক্ষা, বার্ষিকে ৪ স্তরে মূল্যায়ন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002924919128418