প্রতি বছর বিশ্বের মুসলিম সম্প্রদায় একমাস যাবত সিয়াম পালন করে। অন্যান্য ধর্মেও উপবাস থাকা বা রোযার মতো কিছু আচার রয়েছে। আচারের অর্থ হচেছ পবিত্রতা অর্জন করা, আত্মশুদ্ধি এবং আমাদের দৈনন্দিন কাজে সততা ও নিষ্ঠা আনার এক প্রশিক্ষন। এই মাসে সংযম সাধনের সাথে সাথে অপব্যয়ও রোধ করা উচিত। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, রমযান মাস এলে যেন আলাদা এক অপব্যয়ে মেতে ওঠে কিছু লোক। যেমন ইফতার পার্টির নামে চলে অপচয়, লোক দেখানো বড় বড় আয়োজন সেখানে খাদ্য অপচয়ের মহড়া চলে। এটি ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। তবে, এবার সরকার প্রধান তাঁর পার্টির লোকদের ইফতার পার্টি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন যা একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
রমযানে না খেয়ে থাকা শরীরের সংযম আর অন্যান্য খারাপ কাজ, মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ করা থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষন হচেছ আত্মার সংযম। কাজেই রমযান হচেছ শারীরিক ও আত্মিক পবিত্রতা অর্জনের প্রশিক্ষন। কিন্তু আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা যে যেভাবে পারেন অতিরিক্ত লাভের প্রতিযোগিতায় নেমে যান। এটি লাভের মাস, এটি উপার্জনের মাস, একটি বরকতের মাস। তাই বলে, আমাদের অধিকাংশ ব্যাবসায়ীরা যা করেন তা কিন্তু লাভ নয়, এটি হচেছ নিজের লোকসান নিজে ডেকে আনা, সমাজে অশান্তি সৃষ্টি করা। এটি কোনভাবেই রমযানের শিক্ষা নয়।
প্রতিটি মানুষকে রমযান সংযমের শিক্ষা দেয়। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বিক্রি, পচা খাবার-দাবার বিক্রি, অতিরিক্ত দামে বিক্রি--সবই চলছে। বরং এই মাসে যেন আরও বেশি ও বড় আকারে এসব বিষয়গুলো দেখা যায়। তাহলে রমযানের সেই শিক্ষা কোথায়? মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে, পরিবার থেকে এই শিক্ষাগুলো মানুষের অজর্ন করার কথা, তা না হলে সমাজে এর প্রতিফলন ঘটে না। প্রতিবছর আমরা রমযানে এতো এতো প্রশিক্ষন নিচিছ অথচ অফিস- আদালতে ঘুষ কমেনি, মানুষের অহমিকাবোধ কমেনি, পরশ্রীকাতরতা কমেনি । সর্বত্রই অনিয়ম আর বিশৃংখলা। শুধু আচার পালন করা হচেছ। যাকে লোক দেখানো বললেও বেশি বলা হবে না।
এ সময় ব্যাপকহারে বেড়ে যায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি। কেউ বসে নেই। নতুন নতুন কৌশলে এসব হয়ে থাকে। গোটা সমাজকে যদি পরিশুদ্ধ করা না যায় তাহলে পুলিশের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে এসব বন্ধ করা খুব কঠিন। সাময়িক কিছু স্বস্তি মিললেও ক্ষত শুকায়না। আবার বেশিরভাগ সময়ে আমরা সরিসার মধ্যে ভুতের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই। উন্নত বিশ্বে সাধারনত ট্রাফিক ছাড়া সাধারন পুলিশের দেখা পাওয়া যায়না, যদিও পাওয়া যায় সব ধরনে অস্ত্র ছাড়া। অবার মধ্যপ্রাচ্যের ধনী দেশগুলোতেও পদে পদে পুলিশ। পুলিশ দিয়ে সমাজকে সভ্য করা যায় না। সভ্য করতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আদর্শ সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করতে হয়। আর সেটি শুধুমাত্র সরকারই না, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাইকেই ভূমিকা পালনের দ্বায়িত্ব নিতে হয়। তবে সরকারের দ্বায়িত্ব হতে হবে নের্তৃত্বের।
আমরা যদি ব্যক্তি থেকে প্রতিষ্ঠান, প্রতিষ্ঠান থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত লক্ষ্য করলে দেখব যে, রমযানের সংযম শিক্ষার বিষয়টি সেই অর্থে প্রতিফলিত হচেছ না কোথাও। দু’জন মানুষ রাস্তায় সামান্য বিষয় নিয়ে কিংবা অযথাই ঝগড়া বাঁধিয়ে দিচেছ এবং চরম উত্তেজিত অবস্থায় একে অপরকে গালাগাল করছে, এমনকি ‘হাত-পা’ও ব্যবহার করছে। ট্রাফিক নিয়ম কানুন মানছে না, গাড়ীর সামনে দিয়ে যাচেছ। শারীরিকভাবে হেনস্থা করা অহরহই চলছে, রমযান বলে কোন ছাড় নেই। যারা এগুলো করছেন তারা সবাই কিন্তু না খেয়ে আছেন অর্থাৎ রোযা রেখেছেন।
আমরা জাপানের কথা জানি। সেখানে এত ঘন ঘন মসজিদ নেই, ওয়াজ নসিহত নেই, রমযানের মতো প্রশিক্ষণ নেই অথচ সবেই শৃংখলার মধ্যে চলছে। মানুষ অফিসে , কাজে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত, কোন ফাঁকি দেওয়ার চিন্তা নেই। ঘুষ নেই, মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্য, হয়রানি করার জন্য সরকারি আধা সরকারি কর্মকর্তারা বসে নেই। তারা মানুষকে সর্বোত্তম সেবার দেওয়ার জন্য ব্যস্ত, সর্বোচচ চেষ্টাটি করে থাকেন। তাহলে আমাদের হলো টা কী ! আমরা এত ধর্মচর্চা করছি, এত সংযম পালন করছি, মসজিদে দৌঁড়াচিছ - তারপরেও তথৈবচ !!
কিন্তু কেন ? কয়েকটি কারনের মধ্যে মূল কারন হচেছ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ করে ছোটবেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এসব শেখানো হয় জাপানে- আমাদের শেখানো হয়না। কিভাবে বড়দের সম্মান করতে হয়, কিভাবে তাদের সাথে কথা বলতে হয়, কিভাবে খেতে হয় , দেশসেবার নমুনা, দেশকে কেন ভালবাসতে হয় এ শিক্ষা জাপানী ছেলেমেয়েরা ছোট বয়স থেকেই পেয়ে থাকে। প্রকৃত শিক্ষাবিদদের সমন্বয়ে আমাদের শিশুদের জন্য এসবের আদলে শিক্ষাদান করার প্রকৃত প্রচেষ্টাটি গ্রহন করা উচিত। আমরা চেষ্টা করছি, কারিকুলাম আছে, শিক্ষাদনা চলছে কিন্তু যে জন্য এগুলো করা হচেছ তার প্রতিফলন ব্যক্তির মাঝে নেই, সমাজে নেই, স্বাভাবিক কারণে রাষ্ট্রেও নেই। বিষয়গুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষনের দাবি রাখে।
আমরা সবসময় সবকিছু রাষ্ট্রের কাছে আশা করি। কিন্তু সে আশার তো গুড়ে বালি। জনৈক অধ্যাপক (বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত) অল্প কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে রমযানের শেষের দিকে দেশ থেকে কার্যস্থলে চলে যাচেছন। এয়ারপোর্ট থেকে ফোন দিলেন । এয়ারপোর্টের অবস্থা যেন আগের চেয়েও বহুগুন খারাপ হয়েছে। তিনি বলছেন এয়ারপোর্টে প্রবেশের লাইন বাইর পর্যন্ত চলে এসেছে। প্রচন্ড গরমে মানুষ হাঁসফাঁস করছে অথচ কর্তৃপক্ষের দু’পয়সার তৎপরতা নেই যে, দ্রুত ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে যাত্রীদের ভেতরে ঢুকিয়ে দেবেন। অধ্যাপক বলছেন, পরিবর্তন কিভাবে আসবে? কে করবে? রাষ্ট্র না কর্মকর্তা কর্মচারী নিজেরা? কারুরই তো সেভাবে কোন উদ্যোগ নেই। যাই হোক কর্মস্থলে গিয়ে জানিয়েছেন যে তিনি পৌঁছেছেন প্রচন্ড শরীর ও মাথাব্যথা নিয়ে। এতো গেল এয়ার পোর্টের কথা , অন্যান্য ট্রান্সপোর্টের জায়গাগুলো হয়রানির চরম পর্যায়ে। অথচ অধিকাংশই কিন্তু রোযা রেখেছেন, যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার কথা।
প্রতিটি ধর্মেই মানুষকে না ঠকানোর জন্য বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে বলা হয়েছে, যদি কোন মানুষ অন্য কোন মানুষের হক নষ্ট করে অর্থাৎ তার পাওনা তাকে না দেয় কিংবা তার কোন অর্থনৈতিক ক্ষতি করে তাহলে তাকে আল্লাহও ক্ষমা করবেন না যতক্ষন না ওই আক্রান্ত ব্যক্তি তাকে ক্ষমা করে দেন। বিশাল বিষয়। অথচ আমরা খেয়ালই করি না। অহরহ অন্য মানুষের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ছি, মনে কষ্ট দিচিছ, তার পাওয়া দিচিছনা, তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানির চেষ্টা চালিয়ে যাচিছ। যার যতটুকু ক্ষমতা আছে তার চেয়ে ঢের বেশি প্রদর্শনের চেষ্টায় সর্বদাই ব্যস্ত থাকছি আবার উপবাসও করছি। রমযান মাসের প্রশিক্ষনে এগুলো সবই অন্তর্ভূক্ত কিন্ত আমরা তা গ্রাহ্য করছি না। রাষ্ট্র যেমন প্রচুর শিক্ষক প্রশিক্ষন দিচেছ কিন্তু ক্লাসরুম পরিবর্তন হচেছনা, আমাদের শিক্ষাদানে পরিবর্তন আসছে না। এ যেন প্রশিক্ষনের জন্য প্রশিক্ষন, বাস্তবায়নের জন্য নয়, পরিবর্তনের জন্য নয়। একই ঘটনা যেন আমাদের রোযা রাখার মধ্যেও ঘটছে।
পবিত্র রমযানের পর আসে খুশীর ঈদ। মানুষের বিভিন্ন অনৈতিক, আবেগতাড়িত ও অবিবেচনাপ্রসূত কার্যাবলীর কারনে অনেকের জীবনে গভীর অশান্তি নেমে আসে ঈদ যাত্রায়। মানুষ বাড়ীতে যাওয়ার জন্য ঢাকাসহ বড় বড় সিটি থেকে গ্রামের বাড়িতে নাড়ীর টানে ছুটতে শুরু করে। আর এই ছোটা নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের অদ্ভূত সব কর্মকান্ড। অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ বেড়ে যায় বহুগুণে। এগুলো দেখলে মনে হয়, রমযানে ক’জন সহীহ শুদ্ধভাবে রোযা পালন করছে। এমনিতেই বহুল জনসংখ্যার দেশে এই যাত্রা একটি বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছায় কারন সাধারন অবস্থাতেই আমাদের রাস্তাঘাটে জ্যাম লেগে থাকে। আর ঈদ এলে এই জ্যাম পুরোটাই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যায়।
এসব কাজে যারা নিয়োজিত থাকেন তারা অনেক সময় ইচেছ করেই জ্যাম লাগিয়ে থাকেন । মানুষকে কষ্ট দিতে পেরে এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ তারা উপভোগ করেন। যারা রাস্তাঘাট নির্বিঘ্ন করার দায়িত্বে নিয়োজিত তারাও নিজ থেকে কোন উদ্যোগ গ্রহন করেন না, কোন দায়বদ্ধতা নেই, কোন চাপ নেই, নৈতিক কোন তাড়না নেই যে, তাদের এই পবিত্র দায়িত্ব সততার সাথে পালন করতে হবে। তাই প্রতিবছর আমরা দেখতে পাই যানবাহনের দীর্ঘ লাইন, এই লাইন ত্রিশ, চল্লিশ , পঞ্চাশ মাইল কিংবা তারও দীর্ঘ।
বহু পেরেসানির মধ্যে ছটফট করতে থাকা ছোট শিশু ও নারী যারা ঘন্টার পর ঘন্টা, পুরো দিন ও রাত এমনকি ঈদের দিন বিকেলেও অনেক সময় বাসায় পৌঁছাতে পারেন না। এত কষ্ট সহ্য করে যখন বাসায় পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই ফেরার চিন্তাটিও সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো ঘাড়ে চেপে বসে। চিন্তা একটাই; কিভাবে আবার কর্মস্থলে ফিরবেন। এগুলোর জন্য আমরা নিজেদের ভাগ্যকেই দায়ী করি। যখন দেখার কেউ থাকে না, তখন এরকম ভাবনাও অবান্তর নয়।
এরপরেও দিন যাচেছ, সমাজ চলছে, মানুষ তার নিজের প্রচেষ্টায় এগিয়েও যাচেছ, এই তো পৃথিবী, মানুষের হাতে গড়া অদ্ভুত নিয়ম । যে নিয়ম কোনো কল্যাণ বয়ে আনে না। যে নিয়ম রমযানকে আহত করে। পবিত্রতাকে হত্যা করে। সভ্য পৃথিবী কেন এহেন আচরণ মেনে নেবে ! উত্তরে বলতে হয় আমরা এখনো সভ্য হতে পারিনি।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক