১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি। শাসকগোষ্ঠীর লাল চক্ষুর আগুনে টগবগ করে ফুটছে স্বাধীনচেতা বাঙালির রক্ত। আন্দোলন, প্রতিবাদ, মিছিল, মিটিংয়ে দিনগুলো উত্তপ্ত। এরই মধ্যে ঢাকা বার লাইব্রেরি মিলনায়তনে সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মজলুম জননেতা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। টাঙ্গাইলের কৃতী সন্তান আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হন ভাষা আন্দোলনে। টাঙ্গাইলের আরেক কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সোফিয়া খান ও তমুদ্দিন মজলিসের শামসুল আলমও সেই আন্দোলনের সৈনিক। শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এই তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, ফলে ঢাকার আন্দোলনের ঢেউ এসে লাগে টাঙ্গাইলে। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে টাঙ্গাইলও সংগঠিত হতে থাকে। আর এ দায়িত্ব পান সোফিয়া খান। তিনি ঢাকা থেকে টাঙ্গাইলে এসে দিকনির্দেশনা দিয়ে যেতেন।
১৯৫২ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি সোফিয়া খান টাঙ্গাইল আসেন। টগবগে তরুণ বদিউজ্জামান খান ও সৈয়দ নুরুল হুদাকে নিয়ে বৈঠকে বসেন টাঙ্গাইল শহরের প্রধান সড়কে তাঁদের বাড়িতে। সন্ধ্যায় হারিকেন জ্বালিয়ে গোপনে সেই বৈঠক হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট সফল করতে কেন্দ্রীয় নির্দেশ দেন এবং কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তাঁর নির্দেশমতো বদিউজ্জামান খান ও সৈয়দ নুরুল হুদা বৈঠক করেন কমিউনিস্ট নেতা ফজলুল রহমান কায়সার, সৈয়দ আব্দুল মতিন, রমিনুজ্জামান খান রাইজ, আওয়ামী লীগ নেতা তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, প্রিন্স হোটেলের মালিক ফজলুর রহমান খান, আলী আকবর খান প্রমুখ নেতার সঙ্গে।
এদিকে মেয়েদের স্কুল-কলেজে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেওয়া হয় নাজমী আরা রুবি, কোহিনুর ইউসুফজাই, রোকেয়া রহমান, হাসিনা হক ও জরিনা রহমানকে। এরপর সোফিয়া খান গোপনে ঢাকায় চলে যান।
২১ ফেব্রুয়ারি বিক্ষোভের জনপদে পরিণত হয় ঢাকা। ছাত্র-জনতার ওপর চলে শাসকগোষ্ঠীর গুলি। রেডিও বার্তার মাধ্যমে টাঙ্গাইলেও গুলির খবর পৌঁছে। ধর্মঘট সফল করার পূর্বপ্রস্তুতি টাঙ্গাইলের ছাত্ররা নিয়ে রেখেছিলেন। গুলির খবরে তাঁরা জ্বলে উঠলেন।
সৈয়দ নুরুল হুদার নেতৃত্বে সরকারি সা’দত কলেজের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে শহরের দিকে রওনা হন। শিবনাথ উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্বপাশে সেই মিছিলকে গতি রোধ করতে অবস্থান নেয় পুলিশ। মিছিলের সামনের কয়েকজনকে এগিয়ে যেতে বাধা দেওয়া হয়। মিছিলটি পেছনে ঘুরে গ্রাম্য পথে শহরে প্রবেশ করে যোগ দেয় প্রতিবাদসভায়।
অবরুদ্ধ করে রাখা হয় বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কুমুদিনী কলেজে ছাত্রীদের। কুমুদিনী কলেজে ছাত্রীরা গোপনে বৈঠক করছিলেন। বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী জরিনা রহমান একটি জানালা ভেঙে বেরিয়ে তাঁদের অবরুদ্ধ করে রাখার খবর দেন। সেখান থেকে নাজমী আরা রুবি ও হাসিনা হকের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়ে বিন্দুবাসিনী সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সামনে এলে স্কুলের ছাত্রীরা বাধা উপেক্ষা করে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো বেরিয়ে আসেন। স্লোগান দিয়ে সেই মিছিল এসে যোগ দেয় প্রতিবাদসভায়।
টাঙ্গাইল শহরের বর্তমান পৌর উদ্যানে আগে থেকেই প্রতিবাদসভায় মিলিত হয়েছিল ছাত্র-জনতা। সভা শেষে টাঙ্গাইলের ছাত্রনেতারা গোপনে বৈঠক করে তাত্ক্ষণিকভাবে শহরে একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। রমেশ হলের (বর্তমানে সাধারণ গ্রন্থাগার) সামনে অপরিচ্ছন্ন ধুলামাখা বারান্দার দক্ষিণ-পূর্ব কোণে নির্মাণ করা হয় প্রথম শহীদ মিনার। রাজনীতিক খোদা বখশ মোক্তার শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সিমেন্ট দেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন মোহর রাজ।
দুটি ইট কম পড়লে কিশোর নুরুজ্জামান খান ও বুলবুল খান মাহবুব বিন্দুবাসিনী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের একটি পুরনো ইঁদারা (ইন্দারা) থেকে দুটি ইট খুলে আনেন। ঋষিকেশ পোদ্দার পাথরে খোদাই করে শহীদ মিনারে ‘স্মৃতিফলক’ লেখেন। ফজলুল রহমান কায়সার, রমিনুজ্জামান খান রাইজ, তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, শামসুর রহমান খান শাহজাহান, বদিউজ্জামান যাদু ভাই, সৈয়দ আব্দুল মতিন, ফজলুর রহমান খান ফজলু, আলী আকবর খান খোকা রমেশ হলে বসে শহীদ মিনার তৈরির তদারকি করেন। এর পর থেকেই প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হচ্ছে।
লেখক : অরণ্য ইমতিয়াজ, টাঙ্গাইল।