২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে সরকার হটানোর লক্ষ্যে ঢাকাকেন্দ্রিক লাগাতার কর্মসূচিতে যাওয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। তবে মহাসমাবেশ–পরবর্তী কর্মসূচিগুলোয় কোনো ‘রাখঢাক’ করা হবে না। যা করার চিন্তা, তা ঘোষণা দিয়ে অহিংস ও শান্তিপূর্ণভাবে করা হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কোনো ‘অজুহাত’ তৈরির সুযোগ দিতে চাইছে না দলটি।
বিএনপির উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, এই মুহূর্তে তাঁদের দৃষ্টি ঢাকার মহাসমাবেশ বাস্তবায়নের দিকে। তাঁদের লক্ষ্য, রাজধানী ঢাকায় গত ২৮ জুলাইয়ের চেয়েও বড় মহাসমাবেশ করা। সে লক্ষ্যে মহাসমাবেশের আগে ৯ দিন কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি। লম্বা বিরতি দিয়েই ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। যাতে সরকারের পদত্যাগের ‘এক দফা’ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এই মহাসমাবেশ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
বিএনপির নেতাদের আশঙ্কা, এই মহাসমাবেশ ঘিরে আগের মতো ঢাকাসহ সারা দেশে গ্রেপ্তার, হামলা, মামলা বাড়তে পারে। সরকারের দিক থেকে বাধাবিপত্তি আসতে পারে। এসব মাথায় রেখেই দলের নীতিনির্ধারকেরা আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ ও কর্মসূচি ঠিক করছেন। যদিও ১৮ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশের এক দিন আগে থেকেই পুলিশ নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করেছে। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকে ২৪ ঘণ্টায় ৩২৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর সঙ্গে নতুন মামলাও দেওয়া হচ্ছে। আগামী কয়েক দিনে ধরপাকড়, মামলা আরও বাড়তে পারে।
এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দিক থেকেও হামলা, বাধা ও পাল্টা কর্মসূচি আসতে পারে। গত ডিসেম্বর থেকেই বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি করে আসছে আওয়ামী লীগ। সামনের দিনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সরকারি দল থেকেও শক্ত বাধা আসতে পারে বলে মনে করছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। তবে সব ধরনের প্রতিকূল পরিস্থিতির কথা বিবেচনায় রেখেই চূড়ান্ত আন্দোলনের ছক কষা হচ্ছে। সেভাবে নেতা-কর্মীদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জানি, এ ধরনের স্বৈরাচারী সরকার কী কী করতে পারে। তাদের শেষ ভরসা হচ্ছে গ্রেপ্তার, সাজা। এখন শক্তি দিয়ে বাঁচার চেষ্টাই তো তাদের একমাত্র পথ। এ ছাড়া তো তাদের আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু কত লোককে তারা গ্রেপ্তার করবে। গ্রেপ্তার করেও যে তারা টিকবে, সে সুযোগ তো দেখছি না।’
‘মহাযাত্রা’য় কী হবে?
হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্গাপূজার আগে-পরে এবং পূজার ছুটি মিলে ৯ দিন কোনো কর্মসূচি রাখেনি বিএনপি। আজ শুক্রবার পূজা শুরু হচ্ছে। শেষ হবে ২৪ অক্টোবর। পূজার আগে ১৮ অক্টোবর বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে শেষ সমাবেশ করে বিএনপি। এই সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের ঘোষণা এবং ওই মহাসমাবেশ থেকে মহাযাত্রার ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
এই ‘মহাযাত্রার’ ইঙ্গিত কী, জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহাযাত্রা মানে এরপর কঠোর কর্মসূচিতে যাব আমরা।’
দলটির নেতারা বলছেন, তাঁদের কাছে তথ্য আছে, এবারের দুর্গাপূজায় মন্দির-মণ্ডপ লক্ষ্য করে নাশকতা করা হতে পারে। এর দায় বিএনপির ওপর চাপিয়ে সরকার বহির্বিশ্বে বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করতে পারে। এ ছাড়া নতুন করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের ধরপাকড়ের জন্য এটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। গত সপ্তাহে ঢাকার এক সমাবেশে এর ইঙ্গিতও দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি পূজার সময় নেতা-কর্মীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এ কারণে দলীয় সিদ্ধান্তে পূজার এক দিন আগে থেকে পূজার পরসহ ৯ দিন কোনো কর্মসূচি রাখা হয়নি।
যদিও পূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবে ২০ অক্টোবর থেকে ২৪ অক্টোবর—এই পাঁচ দিনে। কিন্তু এক দফার আন্দোলনের এই পর্যায়ে এত লম্বা বিরতি কেন, তা নিয়েও রাজনৈতিক মহলে কথা আছে। অবশ্য বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানান, কৌশলগত কারণেও আন্দোলন-কর্মসূচিতে একটু লম্বা বিরতি দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কার্যত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে একযোগে লাগাতার কর্মসূচিতে যাবে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। যদিও সেই কর্মসূচি এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন দল ও জোটের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাসমাবেশের পর ঢাকাকেন্দ্রিক দু-তিন রকমের কর্মসূচি থাকতে পারে। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন ও সচিবালয় অভিমুখে ‘পদযাত্রা’ বা ‘ঘেরাও’ কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। অথবা রাজধানীর উত্তর ও দক্ষিণের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পদযাত্রার কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে।
সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের দাবিতে গত বছরের জুলাই থেকে এক বছরের বেশি সময় ধরে সারা দেশে বিক্ষোভ, সমাবেশ, পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি করে আসছে বিএনপি। আগামী নভেম্বরের মাঝামাঝি দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে। তফসিলের আগেই সরকার পতনের ‘এক দফার’ ফয়সালা করতে চাইছে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো। এ ক্ষেত্রে কিছুটা সংশয়ের কারণ হয়েছে বিগত ২৯ জুলাই ঢাকার চার প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি। আগের দিন ২৮ জুলাই ঢাকায় কয়েক লাখ মানুষের মহাসমাবেশ করার পরের দিন ‘অবরোধ’ কর্মসূচি ঠিকভাবে করতে পারেনি। সেদিন পুলিশ ও ক্ষমতাসীনদের বাধা ও হামলার মুখে শনির আখড়া ছাড়া আর কোথাও বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাস্তায় সেভাবে দাঁড়াতে পারেননি।
এখন বিএনপিসহ বিরোধীরা ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ থেকে সরকার হটাতে লাগাতার আন্দোলনের যে পরিকল্পনা করছে, তা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনৈতিক মহলে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, বিএনপিকে দাঁড়াতে দেওয়া হবে না। এর সঙ্গে শুরু হয়েছে গ্রেপ্তার।
অবশ্য বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, যে গ্রেপ্তার শুরু হয়েছে, এটা চলতে থাকবে, থামবে না। তাতে করে জনগণকে আর আটকানো যাবে না।