ইংরেজিতে একটি কথা বলা হয়, তা হলো ‘Dialogue is alternative to violence’. এর বাংলা করলে দাঁড়ায় সংলাপ হলো সংঘাতের বিকল্প। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশই নানারকম সংকট এবং সংঘাতের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। একেক দেশের সংকটের ধরন একেক রকম। আমাদের আশপাশের দেশ, যেমন-ভারত এবং পাকিস্তানেও রাজনৈতিক সংকট রয়েছে। অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলাই বাহুল্য। সমস্যা যতো প্রকটই হোক না কেনো তা মোকাবিলার জন্য প্রয়োজন সব পক্ষের পরামর্শ এবং যৌথ উদ্যোগ। কিন্তু এটাবই সংকট সরচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এখন চরম হতাশার নাম হচ্ছে রাজনীতি, যেখানে আগে পিছে শুধু সংঘাত আর সংঘাত। এখন প্রশ্ন হলো এর থেকে কি কোনো পরিত্রাণ নেই? আছে, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়ানো। যাকে অনেকে সংলাপও বলে থাকেন। বাংলাদেশের বড় দলগুলো সাধারণত রাজনীতি সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করে তা হলো ‘Politics of annihilation’। এখানে প্রতিপক্ষের বা বিরোধী মতের কোনো গুরুত্ব সরকারি দলের কাছে নেই। প্রতিপক্ষকে শেষ করাই যেনো এখানে রাজনীতির মূল লক্ষ্য।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আবহাওয়ার সঙ্গে রাজনীতির একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। শীতকাল এলেই আমাদের রাজনীতির মাঠ গরম হয়। আগামী ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা, সেই নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ইতিমধ্যে তোলপাড় অবস্থা শুরু হয়ে গেছে। নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল পুরোপুরি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। সরকারি দলের নেতারা বলছেন, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। অন্যদিকে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপির নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। নির্বাচনের আগে সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নেতাদের এই মাঠ গরম করা বক্তৃতা-বিবৃতিতে কর্মীদের মধ্যেও নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। সেই প্রতিক্রিয়া কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যা হয় না। কিন্তু সেটি যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উত্তপ্ত করে, এক দলের কর্মীরা আরেক দলের কর্মীদের ওপর হামলা চালান, তখনই মহাউদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বস্তুত হচ্ছেও তাই। নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ এবং নির্বাচনের আগে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি ধারাবাহিক বিভাগীয় গণসমাবেশ করে সবশেষ ২৮ অক্টোবরের ঢাকার মহাসমাবেশের পর থেকেই রাজপথের বড় এ দলের শীর্ষনেতাদের প্রায় সবাইকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। সরকারের প্রধান প্রতিপক্ষ যাতে মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে অথবা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের চাওয়া যাতে নির্বিঘ্ন হয় সে ভাবনা থেকেই এমন গ্রেফতার অভিযান চালানো হয়ে থাকতে পারে বলে রাজনীতি নিয়ে যারা ভাবেন তাদের মত। এ চিত্র নতুন নয়, শুধু ক্ষমতায় থাকা দলের বদল হয়। বিএনপি এখন ক্ষমতায় থাকলেও পরিস্থিতি হয়তো একই হতো। সংকটের মাত্রার তারতম্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে।
যোগাযোগ বা ইংরেজি কমিউনিকেশন শব্দটি ল্যাটিন শব্দ কমিউনিস থেকে এসেছে। কমিউনিস শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘সাধারণ’। তাই যোগাযোগ বলতে দুই বা ততোধিক বাক্তির মধ্যে তথ্যাদি বিনিময়ের মাধ্যমে সাধারণ সমঝোতায় পৌঁছানোকেই বোঝায়। এখন প্রশ্ন হলো আমরা রাজনীতির নানা ইস্যু নিয়ে কি কোনো সমঝোতায় এই ৫২ বছরে পৌঁছাতে পেরেছি? এর উত্তর কোনো কিছু না ভেবেই দেয়া যায় ‘না’। দেশের সাধারণ মানুষ শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে মার খাবে অথবা যে প্রতিপক্ষ তাকে নিঃশেষ করে দেবে তাতো হয় না, হওয়া উচিত না। অনেকেই জেনে থাকবেন ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের পার্ল হারবারে অবস্থিত মার্কিন নৌঘাঁটিতে হঠাৎ আক্রমণ করে বসে জাপানের সামরিক বাহিনী। জাপানের এই আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব হিসাবনিকাশ পাল্টে যায়। জাপানের এই অতর্কিত ও ধ্বংসাত্মক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বযুদ্ধে উদাসীন থাকা যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে অংশ নেয় সক্রিয়ভাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে জাপান ছিলো আগ্রাসি একটা দেশ। চীনের সঙ্গে পরপর দুটি যুদ্ধজয়ের পর রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধজয়ে জাপান আরো বেশি আগ্রাসি হয়ে ওঠে। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জয়লাভ করায় জাপান আরো সাম্রাজ্যবাদী হয়ে ওঠে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বাঁচতে জাপান আধিপত্য প্রসারের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে চীনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের মধ্য দিয়ে জাপান তাদের আধিপত্য বিস্তার শুরু করে। জাপানের এই আক্রমণাত্মক মনোভাব যুক্তরাষ্ট্র ভালোভাবে নেয়নি। প্রথমে হুঁশিয়ার করেও ফল না আসায় যুক্তরাষ্ট্র জাপানের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফলে জাপান যুক্তরাষ্ট্র থেকে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র আমদানি করা থেকে বঞ্চিত হয়। বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠক হলেও সেসব ফলপ্রসূ হয়নি। বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার এক দশক আগে থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের যুদ্ধ একপ্রকার অনিবার্য হয়ে ওঠে। জাপানের আক্রমণ কিন্তু দেশটির জন্য মোটেও সুখকর ছিলো না বরং যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটম বোমার আঘাতের চিহ্ন দেশটিকে আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের ওই সংঘাত এড়ানো সম্ভব ছিলো সংলাপ তথা যোগাযোগের মাধ্যমে। মনে রাখা দরকার সংলাপ ব্যর্থ হলে কোনো পক্ষেরেই আর জয়ী হওয়া হয়ে ওঠে না।
অনেক ত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা আমরা রক্ষা করতে পারছি কি? এখানে সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনতাপ্রিয়। কিন্তু এ স্বাধীনতা খুব সহজলভ্য নয়। অনেক কষ্ট ও সংগ্রামের ফলে স্বাধীনতা অর্জিত হয়। স্বাধীনতা লাভ করা একটি জাতির জন্য অত্যন্ত গৌরবের ব্যাপার। যেটা জাতি হিসেবে আমরা করতেই পারি। কারণ, এটা আমরা অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন করেছি। তবে স্বাধীনতা রক্ষায় অধিক সতর্ক, সচেতন এবং সৃষ্টিশীল হতে হয়। স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। স্বাধীনতা অর্জন করা যে কোনো পরাধীন জাতির পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কাজ। স্বাধীনতা অর্জিত হলে তা রক্ষা করা আরো কঠিন কাজ। স্বাধীনতা অর্জন করতে শক্তি, সাহস, সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং বহু রক্তদানের প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, শক্তিমান শাসকগোষ্ঠী পদানত জাতিকে কখনই স্বাধীনতা দান করে না; বহু ত্যাগ ও রক্তপাতের মাধ্যমেই তা অর্জন করতে হয়। তবে স্বাধীনতা অর্জিত হলেই চিরস্থায়ী হয় না। তা যেকোনো সময় হরণ হতে পারে। তাই স্বাধীনতা অর্জনই মূল উদ্দেশ্য নয়। একে সমুন্নত রাখা, রক্ষা করা একটি সার্বক্ষণিক কাজ। আর এর জন্য প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। শুধু ভূ-খণ্ড থাকলেই স্বাধীনতা আছে বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। এটা অর্জন করবার জন্য যেমন দেশের সকল মানুষকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়। এটা রক্ষা করতেও সকলকে একসঙ্গে কাজ করতে হয়, চর্চা করতে হয়। সেজন্য সবসময় পক্ষ-বিপক্ষ, সব মহলের মধ্যে একটা সামাজিক সম্পর্ক থাকা দরকার। আলাপ, সংলাপ এবং সামাজিক যোগাযোগ থাকা খুব জরুরি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, সংবিধান অনুসারে বর্তমান সরকারের অধীনে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিতে যাবে। এদের একটি অংশ ও আন্দোলনকারীরা মনে করে, সংসদ ভেঙে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে হয়তো বিএনপি তথা আন্দোলনকারীরাই জিতে যাবে। কিন্তু তাতে আপামর জনসাধারণের বিজয় হবে না। জনগণের বিজয় চাইলে এই দুই দলকেই গণতন্ত্রের জন্য অনেক কাজ করতে হবে। গণতন্ত্র একটা মূল্যবোধের নাম। গণতন্ত্র মুখে নয়, কাজের মাধ্যমে, চর্চার মাধ্যমে এমনকি আচরণের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে যে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক। দেশকে যদি আমরা জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র করতে চাই তাহলে সব পক্ষকে নিয়ে আমাদের বসে সংলাপ করে এমন একটি ব্যবস্থা বের করতে হবে যাতে আগামীতে আর কোনো নির্বাচনই যেনো প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। দেশকে ভালোবেসে নিজের দেশের মানুষের কাছে যদি হারতে হয়, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! দেশে বর্তমানে নির্বাচনকে সামনে রেখে এমন সংঘাতময় পরিস্থিতি কোনো সাধারণ মানেুষের কাম্য নয়। যোগাযোগ তথা সংলাপের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে বের হতে না পারলে শুধুই যারা ক্ষমতালোভী তারা জিতে গেলে এ দেশের মুক্তিকামী জনমানুষের পরাজয়ও সেই সঙ্গে নিশ্চিত হবে।
লেখক: এম মাহবুব আলম, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা/ সাংবাদিক ও শিক্ষক
শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।