রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দুই বাসের চাপায় হাত হারানোর পর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেনের মৃত্যুর ঘটনায় সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১৮ দফা সুপারিশসহ প্রতিবেদন হাইকোর্টে জমা দিয়েছে তদন্ত কমিটি। হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত এ কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজীবের মৃত্যুতে দুই বাসচালক ও হাসপাতালের চিকিৎসাজনিত অবহেলার দায় রয়েছে। কারণ, দুর্ঘটনার পর তাকে রাজধানীর শমরিতা হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাৎক্ষণিকভাবে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে দুই চালকের কারোরই ভারী যানবাহন অর্থাৎ বাস চালানোর লাইসেন্স ছিল না।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে গতকাল সোমবার ৪৯ পৃষ্ঠার এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এর আগে গত রোববার তদন্ত কমিটির পক্ষে আদালতে ওই প্রতিবেদন দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাত হারানোর ঘটনায় রাজীবের কোনো দায় ছিল না। বরং বিআরটিসি ও স্বজন পরিহনের চালকদেরই দায় ছিল। তাদের হালকা যানবাহন চালনার লাইসেন্স ছিল। প্রতিবেদনে চালকদের ট্রিপভিত্তিক গণপরিবহন চালানোর বিষয়টি বাতিল, মাসিক ভিত্তিতে চালকদের বেতন নির্ধারণসহ সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কমিটি ১৮ দফা সুপারিশ করেছে। প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণের পর আগামী ১৪ নভেম্বর হাইকোর্টের জারি করা রুলের শুনানির জন্য দিন ধার্য করা হয়েছে।
কমিটির সুপারিশ- ১. বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) বিভাগের উন্নয়নে বাজেট বরাদ্দ; ২. মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, পুলিশ, বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট, নিরাপদ সড়ক চাইসহ সংশ্নিষ্ট সবাইকে নিয়ে কারিগরি টিম গঠন ও অর্থ বরাদ্দ; ৩. দুর্ঘটনাপ্রবণ সড়কে সিসিটিভি স্থাপন; ৪. দুর্ঘটনার বিষয়ে পুলিশের নথি সংগ্রহ, সংরক্ষণ; ৫. অনুসন্ধান এবং সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা; ৬. বাসের ফিটনেস নিয়মিত তদারকি; ৭. বিআরটিসি বাস চলাচলে লিজ পদ্ধতি বাতিল; ৮. চলন্ত অবস্থায় গাড়ির দরজা বন্ধ রাখা ও দাঁড়িয়ে যাত্রী না নেওয়া; ৯. যাত্রী ছাউনি স্থাপন ও তদারকি করা; ১০. বিআরটিএ কর্তৃক বাধ্যতামূলক একটি ড্রাইভিং স্কুলের ব্যবস্থা করা; ১১. থিওরি টেস্টের মাধ্যমে বিভিন্ন টপিকের মাধ্যমে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া এবং চালককে লাইসেন্স দেওয়ার আগে বুয়েট ও বিআরটিএর মাধ্যমে প্র্যাকটিক্যাল টেস্ট নেওয়া; ১২. দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তির দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করা; ১৩. ট্রিপ পদ্ধতি বা দৈনিক ভিত্তিতে ড্রাইভার নিয়োগ পদ্ধতি বাতিল করা; ১৪. চালকদের মাসিক বেতন ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া; ১৫. দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে ও বেপরোয়া যান চলাচল বন্ধে রাজধানীর রুটগুলোতে ফ্র্যাঞ্চাইজ ভিত্তিতে বাস চলার পদ্ধতি চালু করা; ১৬. বৈধ লাইসেন্সের ভিত্তিতে একটি রুটে মাত্র একটি কোম্পানির বাস চলাচলের ব্যবস্থা করা; ১৭. রুট বা শহরভিত্তিক ফ্র্যাঞ্চাইজ পদ্ধতিতে প্রতিটি রুট ভিন্ন ভিন্ন রঙিন কোড দিয়ে পরিচালনা করা এবং ১৮. এসব পদ্ধতি চালু করে যাত্রীদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চিত করা ও বাস কোম্পানিগুলোর চালকদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা রোধ করা।
আদালতে রাজীবের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। পরে রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তিতুমীর কলেজের ছাত্র রাজীবের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে কয়েকটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, রাজীবকে যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। এই কমিটি জরিমানার পাশাপাশি সামগ্রিক সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা আনার জন্য কিছু সাধারণ পরামর্শ দিয়েছে। ১৪ নভেম্বর রুলের শুনানি শুরু হলে বিষয়গুলো আবারও আলোচনায় আসবে।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু সাংবাদিকদের বলেন, দুই বাসের প্রতিযোগিতায় কীভাবে রাজীব হাত হারিয়েছেন, তা এতে তুলে ধরা হয়েছে। দুর্ঘটনার জন্য কে, কীভাবে দায়ী, তাও চিহ্নিত করা হয়েছে। রুলের শুনানির পর আদালতের রায়ে প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন হবে।
গত ৩ এপ্রিল দুই বাসচালকের বেপরোয়া গাড়ি চালানোর শিকার হন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন। একটি হাত কাটা যাওয়ার পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর ৪ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। ওই রিটের শুনানি চলা অবস্থায় ১৭ এপ্রিল রাজীবের মৃত্যু হয়। এক পর্যায়ে আপিল বিভাগের আদেশে দুর্ঘটনার দায় নির্ধারণে হাইকোর্ট একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। গঠিত এ কমিটির সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিচার্স ইনস্টিটিউটের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, সিভিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান ও নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। গত রোববার এই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।