রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ শেষ হয়েছে গত ২১ মার্চ। এর ১১ দিন পরও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি কমিটি। কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে, সেটিও বলতে পারছেন না তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকেরা বলছেন, মূলত তাৎক্ষণিক উত্তেজনা প্রশমনের জন্য এসব কমিটি গঠন করা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, ১১ মার্চ সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে একজন বাসচালকের কথা–কাটাকাটির জের ধরে বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষের সূত্রপাত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজন এ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। হামলা-সংঘর্ষ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছোড়া কাঁদানে গ্যাসের শেলে আহত হন দুই শতাধিক শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে একটি পুলিশ বক্স ও রাস্তার ধারের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঘটনার প্রতিবাদে ১২ মার্চ সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এ সময় তাঁরা চারুকলাসংলগ্ন রেললাইন ও ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অগ্নিসংযোগ করে সড়ক অবরোধ করেন। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা করে।
সংঘর্ষের দুই দিন পর ১৩ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য হুমায়ুন কবীরকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে ওই দিন থেকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, সহকারী প্রক্টর আরিফুর রহমান, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর তারিকুল হাসান, অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রশিদ সরকার ও সিন্ডিকেট সদস্য মো. শফিকুজ্জামান জোয়ার্দ্দার।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘তদন্ত প্রায় শেষের দিকে। যাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম, তাঁদের অনেকের কাছেই পৌঁছাতে পারছিলাম না। ফলে কয়েক দিন বেশি সময় লেগে গেছে। রোজার কারণেও দেরি হচ্ছে। তবে আমাদের প্রতিবেদন লেখা শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি, শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’
কবে নাগাদ প্রতিবেদন জমা দেয়া হতে পারে—এ প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনো উত্তর দিতে পারেননি হুমায়ুন কবির। তিনি বলেন, ‘তারিখ নির্দিষ্ট করে বলা মুশকিল। কারণ, এটা তো আমার একার হাতে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিবেদন জমা দেব।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যজন মলয় ভৌমিক বলেন, ‘এ উপমহাদেশে অনেক ঘটনারই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ঘটনার প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখে না। এটি বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে। তবে দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে ঘটনাটির একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়া এবং সে অনুযায়ী দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।’
সাধারণত একটা খারাপ পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে এসব কমিটি করা হয় বলে মন্তব্য করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ হাসান। তিনি বলেন, ‘আমরা দেখি যে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঘটনা ঘটলে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু এর প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত কেউ জানতে পারেন না। এ ধরনের ঘটনার দায়দায়িত্ব কার থাকে, আমরা সেটিও পরিষ্কারভাবে জানতেও পারি না। এ ঘটনায়ও এমনটি হয়ে থাকতে পারে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ঘটনায় এর আগে অনেক কমিটি গঠন করা হলেও কোনোটি আলোর মুখ দেখেনি বলে মন্তব্য করেন অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান।
তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী মেডিকেলে মার খাওয়ার ঘটনায়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের শিক্ষার্থীদের ওপর যে নিপীড়ন চালানো হচ্ছে, এরও কোনো প্রতিবেদন আমরা পাইনি। এত বড় একটা ঘটনা, এত শিক্ষার্থী রক্তাক্ত হওয়ার পরও যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্তে ঢিলেমি করে, তবে সেটা দুঃখজনক।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) আন্দোলন মঞ্চের সমন্বয়ক আবদুল মজিদ বলেন, এ ঘটনায় প্রশাসনের কাছে দ্রুত তদন্তের দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। প্রশাসন জোর দিয়ে বলেছে যে এই প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখবে। তাই তাঁরা সাত কার্যদিবস সময় নিয়েছে। কিন্তু সেই ৭ কার্যদিবসের আরও ১১ দিন পেরিয়ে গেলেও তাঁরা প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এতে প্রশাসনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন শিক্ষার্থীরা। কোনো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না হওয়ায় একই ধরনের অপরাধ বারবার সংঘটিত হচ্ছে। অপরাধীরা পার পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বারবার অপরাধ করছে। ভুক্তভোগীরা আরও হতাশ হয়ে পড়ছেন। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়ছে।