রাবির গেস্টহাউসের জমি ক্রয়ে অনিয়ম, নেই আইনি পদক্ষেপ

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ঢাকায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) গেস্টহাউসের 'জমি ক্রয়ে' ব্যয় করা টাকা কোনো কাজে আসেনি। আইন উপদেষ্টার সুপারিশ উপেক্ষা করে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ প্রকল্প বাবদ ১০ কোটি টাকা ব্যয় দেখালে সে সময় এতে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের একটি পক্ষ অভিযোগ করে- জমি ক্রয়ের নামে অন্তত সাড়ে সাত কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন ও উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সারওয়ার জাহান। তবে দু'জনেই বরাবর অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। এদিকে, এই অনিয়মের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে 'তথ্যানুসন্ধান কমিটি' দেড় বছর আগে সুপারিশ করেছে। তবে এখনও কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করছে বলে জানা গেছে। মঙ্গলবার (২২ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সৌরভ হাবিব ও নুরুজ্জামান খান।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ২০১৫ খ্রিষ্ঠাব্দের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভা ঢাকায় গেস্টহাউস নির্মাণের অনুমতি দেয়। ঢাকায় জমি নির্বাচনসহ এই প্রকল্প দেখভালে উপ-উপাচার্য সারওয়ার জাহানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেন উপাচার্য। প্রকল্পের শুরু থেকে তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০১৭ খ্রিষ্ঠাব্দের মে মাসে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্বে আসেন অধ্যাপক এম আবদুস সোবহান। ওই বছরের ২৫ জুলাই উপাচার্যের অনুমতিতে সিন্ডিকেটের 'এক্সট্রাঅর্ডিনারি' সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের 'স্বার্থে' এই অনিয়ম খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি এ প্রকল্পে অর্থ ব্যয়ে নানা অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেয়। গত বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও ২৬ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং দুদকে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন। কমিটি জমি ক্রয় ও ভবন নির্মাণের ১০ কোটি টাকার চুক্তি বাতিল করে টাকা ফেরত নিতে এবং আইন উপদেষ্টার পরামর্শ উপেক্ষা করে ও এ বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে জমি ক্রয়ের সঙ্গে সংশ্নিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করে।

জানতে চাইলে তথ্যানুসন্ধান কমিটির আহ্বায়ক ও রাবি উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোলাম কবীর বলেন, 'কমিটি ক্রয় প্রক্রিয়ায় নানা ত্রুটি পেয়েছে। কোনো জমি বা ইমারত কিনতে হলে যেসব নিয়ম মানতে হয়, তার কিছুই মানা হয়নি। একজনের কাছ থেকে জমি কেনা হয়েছে, অথচ ওই জমিতে একাধিক ব্যক্তির মালিকানা রয়েছে। এ প্রকল্পের সবকিছুই ত্রুটিপূর্ণ।'

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গেস্টহাউস নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে একবার পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করে ২০১৬ সালের ২৩ জুন পুনঃদরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় ফের বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। দরপত্রে 'এলডোয়ার্ডো প্রপার্টিজ' উদ্ৃব্দত মূল্য ১৩ কোটি ৬৫ লাখ ৪০ টাকা এবং 'মেট্রো হোমস' উদ্ৃব্দত মূল্য ১১ কোটি ৯৫ লাখ ৬০ হাজার ৮১৫ টাকায় অংশ নেয়। তবে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সুপারিশ বাতিল করে খালিদ মাহমুদের (জমির মালিক) কাছ থেকে সাড়ে তিন কাঠা জমি তিন কোটি ৫০ লাখ টাকায় ২০১৬ সালের ২০ অক্টোবর ধানমন্ডি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সম্পাদিত সাব-কবলা দলিলের (নম্বর ১৩৩১/১৬) মাধ্যমে ক্রয় করেন। ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্তে দলিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক সায়েন উদ্দিন আহমেদ ও রেজিস্ট্রার অধ্যাপক এম এন্তাজুল হক স্বাক্ষর করেন। ক্রয় কমিটির সিদ্ধান্তের রেজুলেশনে উল্লিখিত জমির মূল্য ১১ কোটি টাকা এবং জমিতে ভবন নির্মাণ ব্যয় দুই কোটি ২৫ লাখ টাকাসহ এ খাতে সর্বমোট ১৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচ দেখানো হয়। তবে জমির সাব-কবলা রেজিস্ট্রি দলিল সম্পাদনের ৩৬ দিন পর (২০১৬ সালের ২৬ নভেম্বর) তিনশ' টাকার ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে জমি বিক্রেতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কোষাধ্যক্ষ ও রেজিস্ট্রার 'জমি ক্রয়-বিক্রয় ও ভবন নির্মাণ চুক্তিপত্র' সম্পাদন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, একই বছরের ২৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় টেবিল এজেন্ডা (তাৎক্ষণিক উপস্থাপিত) হিসেবে জমির মালিকের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিপত্র 'কৌশলে' অনুমোদন করিয়ে নেয় প্রশাসন। জমিতে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন ভবন নির্মাণের কথা বলা হলেও দলিলে উল্লিখিত মূল্য তিন কোটি ৫০ লাখ টাকার বিষয়টি গোপন রাখা হয়। সিন্ডিকেটে এর মূল্য ১১ কোটি (জমি ও ভবন নির্মাণ) টাকা দেখানো হয়। সিন্ডিকেটের অনুমোদনক্রমে তিন দফায় ১০ কোটি টাকা জমির মালিককে পরিশোধ করেছেন বলেও সে সময় প্রশাসন জানায়।

জানতে চাইলে রাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মিজানউদ্দিন বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব নিয়ম-নীতি ছিল, তা মেনেই এটি করা হয়েছিল। এর কাজের জন্য একটি কমিটি করা হয়েছিল। কমিটির সুপারিশে সিন্ডিকেট কাজের অনুমোদন দেয়।' তিনি আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেন।

এদিকে, আলোচিত এই অনিয়মের সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। অনিয়মের বিষয়ে ইউজিসির অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান। গতকাল সোমবার দুপুরে ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক কামাল হোসেনকে মোবাইলে কল করা হলে তিনি ব্যস্ত আছেন বলে ফোন রেখে দেন। বিকেলে যোগাযোগের চেষ্টা করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান বলেন, হাইকোর্টে রিট করা হয়েছিল। সেটি হলে দুদকের তদন্ত করার কথা। দুদক তদন্ত করছে কিনা, জানি না। তদন্ত করে কিছু পেলে তারা মামলা করবে, এটাই প্রক্রিয়া। আমরা দুদককে সহযোগিতা করছি, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটেছে, সেটি দুদক অবগত হয়।

দুদকের রাজশাহীর উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত প্রতিবেদনসহ অভিযোগ ঢাকায় জমা দিয়েছে। করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় বিষয়টি এগোয়নি। তবে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর কাজ শুরু হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025081634521484