রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর চরম বর্বরতা

বিপ্লব বড়ুয়া |

‘বৈষম্যবিরোধী’ ছাত্র আন্দোলনকে কৌশলে নাশকতার কাজ লাগিয়ে দেশবাপী একশ্রেণির দুর্বৃত্ত জনগোষ্ঠী যেভাবে ঢাকাসহ দেশজুড়ে তাণ্ডবলীলা  চালিয়েছে তা এক কথায় অবিশ্বাস্য রোমহর্ষক। রাষ্ট্রীয় সম্পদের ওপর এমন বর্বরতা বাংলাদেশের মানুষ অশ্রুশিক্ত নয়নে প্রত্যক্ষ করেছে। যে বর্বরতা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে উন্নত বিশ্বের আদলে গড়া মেট্রোরেল স্টেশনও বাদ যায়নি দুস্কৃতিকারীদের হাত থেকে। উদ্বোধনের কয়েকমাসের মাথায় মেট্রোরেলের অত্যাধুনিক ২টি স্টেশন লুটেপুটে নিয়ে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে। এ ছাড়া বীভৎসতা দেখেছি ঢাকা, চট্টগ্রাম, নরসিংদী, মাদারীপুর, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, বরিশালসহ দেশের সর্বত্র। 

বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা গত ১৮ জুলাই দেশব্যাপী ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ডাক দেন। এ ঘোষণায় পুরো দেশ একরকম অচল হয়ে যায়। ছাত্রদের এ আন্দোলনকে পুঁজি করে নাশকতাকারীরা ওই একদিনেই দেশের হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ আগুনে পুড়ে ধ্বংস করে দেয়। এ রকম জঘন্য, নির্মম বর্বরতা দেশের মানুষ আগে কখনো দেখেনি। ওইদিন বিকেল থেকে রাত অবধি একদল দুর্বৃত্ত ছাত্রদের আন্দোলনকে কাজে লাগিয়ে দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, মহাখালির সেতু ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, ডাটা সেন্টার, গ্রীন রোডের রপ্তানি ভবন (বেপজা), মিরপুরে বিআরটিএ ভবন, ২টি মেট্রোরেল স্টেশন, গাজীপুরের সড়ক ভবন, বিআরটি স্টেশন, মহাখালির এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, যাত্রাবাড়ি মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, নরসিংদী জেলা কারাগার ভেঙে ফেলায় আট শতাধিক বন্দি পালিয়ে যাওয়ার পর লুটপাট, মাদারীপুরে জেলাপ্রশাসকের কার্যালয়সহ অসংখ্য সরকারি স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আগুন দিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে।

আগুন দিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর পুলিশের গাড়ি, পুলিশ বক্সসহ অসংখ্য যানবাহনে। মহাখালির সেতু ও সড়ক ভবনে ৫৫টি গাড়ি, মহাখালির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পুরোনো ভবনের পার্কিংয়ে রাখা ৩২টি গাড়ি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোশনের ৪৬টি বর্জ্যবহনকারী গাড়ি, মাদারীপুরে একটি কোম্পানির ৩২টি বিলাসবহুল বাসসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায় দুই শতাধিক দামি গাড়িতে পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছে নাশকতাকারী দুর্বৃত্তরা। ঢাকা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে স্টেশন দুটিতে এমনভাবে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছে পুরোদমে চালু করতে অন্তত একবছর সময় লাগবে। এসব সরকারি সম্পদগুলোকে এমনভাবে ধ্বংযজ্ঞে পরিণত করেছে, কোনো বিবেকবান মানুষ এ কাজ করতে পারে না। ছাত্রদের আন্দোলনকে খুব সূক্ষ্ম কৌশলে ব্যবহার করেছে দুস্কৃতকারীরা। সরকার এই নাশকতার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করেছে।

ছাত্রদের আন্দোলনটি ছিলো সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক যে কথাটি তারা বার বার বলে আসছিলেন। প্রায় ১৭/১৮ দিন একটানা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনটিকে অশান্তিতে পরিণত করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকার করেছে একশ্রেণির রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতেই মূলত এরা দেশব্যাপী নাশকতা পরিচালনা করে। যে বা যারা এ ধরনের প্রতিহিংসামূলক কর্ম করেছে তারা যে একটি টার্গেট নিয়ে এগিয়েছে তাদের কর্মযজ্ঞে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুস্কৃতকারীরা একাধিকবার অকটেন, পেট্রোল ঢেলে গাড়িতে আগুন লাগানোর কথা সেতু ভবন ও সিটি করপোরেশনের কর্মচারীরা গণমাধ্যম কর্মীদেরকে অবহিত করেছেন। রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে থেকে নবীন ছাত্রদের কোটা সংস্কার যৌক্তিক আন্দোলনে দেশের মানুষ সর্বাত্মক সাড়া দেয়। যারা এই আন্দোলনকে পরিচালনা করেছে তাদের বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। কারণ, তাদের প্রত্যেকটি দিকনির্দেশনা ছিলো সময়োপযোগী। তাদের এই নেতৃত্ব একজনের ওপর নির্ভরশীল ছিলো না। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকজনের নাম জেনেছি তারা হলেন- সমন্বয়ক সারজিস আলম, আহসনাত আবদুল্লাহ, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদ ও সহসমন্বয়ক হাসিব আল ইসলাম।  

ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তাদের বিবৃতি প্রকাশিত ও প্রচারিত কথামালা শুনে আমার কাছে মনে হয়েছে তারা প্রত্যেকে মেধাবী, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এবং পরিপক্ক। আন্দোলন পরিচালনকালীন তাদের প্রত্যেকের কথামালায় একে অন্যের মধ্যে বেশ সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা গেছে। সে কারণে রাজনীতিকরা তাদের আন্দোলন নিয়ে বিদ্রূপাত্মক মন্তব্য করার পরও কোনো অবস্থাতে টলে যায়নি। উপরোন্তু, ছাত্ররা খারাপ মন্তব্য করা থেকে বিরত ছিলেন। যেটি, বাংলাদেশের অভিজ্ঞ রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। আমি মনে করি ছাত্ররা তাদের নেতৃত্বের মধ্যে দিয়ে একটি সুন্দর মার্জিত ধারা প্রচলন করার ফলে সে ধারাটি খুব দ্রুত সবস্তরে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের তরুণ সমাজ যদি প্রতিটি অনিয়মের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের মাধ্যমে সরব হয় তাহলে এদের মধ্যে দিয়ে আগামীতে বাংলাদেশ একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত  হতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। তারা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ এর ধারণাটিকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। যেটি এর আগে দেখা যায়নি। মনে রাখতে হবে বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থীরা মেধাও সৃজনশীলতায় অনেক বেশি এগিয়ে। তরুণরা তথ্যপ্রযুক্তিতে অনেক অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্ম প্রতিনিয়ত এখন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে। তথ্য প্রযুক্তিতে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনের ফলে তরুণ প্রজন্ম এখন ঘরে বসে অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে যেটি বড়দের বেলায় কখনো সম্ভবপর নয়। তারা প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। ফ্রিল্যান্সার, ই-কমার্সে দিনরাত প্রতিনিয়ত বিশ্বের উন্নত দেশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে তারা শুধু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে তা শুধু নয় এ জাতীয় চ্যালেঞ্জগুলো তাদের হৃদয়ে সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছে। আত্মবিশ্বাস স্বপ্ন দেখাতে শেখায়। যে স্বপ্ন মানুষকে নিয়ে যায় বহুদূর। তাই এখন বড় ছোট বলে কাউকে অবজ্ঞা বা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার সুযোগ নেই।

অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান হচ্ছে সমুদ্রসম। যাদের মধ্যে এই দুটি বিদ্যমান তারা সহজে পরাস্ত হয় না। অর্থের ব্যাপারটা হচ্ছে সাময়িক। অর্থ সারাজীবন টিকে থাকে না অপরদিকে জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা কখনো ম্লান হয় না। যে যতোবেশি অজ্ঞিতাসম্পন্ন সে ততোবেশি সমৃদ্ধ। আজকে তরুণ শিক্ষার্থীরা তাদের সুষ্ঠু ও শান্তিপুর্ণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে যে সুস্থধারার প্রচলন করেছে তা রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয় ব্যাপার। তরুণ প্রজন্মের নতুন নতুন চিন্তার সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময় করে নবতর কর্মসূচি প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেয়ার কর্মসূচি নিতে হবে। ছাত্রদের আন্দোলনকে হাতিয়ার হিসেবে নিয়ে যে বা যারা দেশের সম্পদ লুটপাটের উৎসবে মেতেছিলো তারা আর যাই হোক দেশের মঙ্গলকামী নয়। যারা এই নৈরাজ্য চালিয়েছে তারা একশ্রেণির উগ্রবাদী ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এদের বিরুদ্ধে সরকারকে আরো বেশি কৌশলী হতে হবে। 

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064620971679688