ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগের পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সেই অধ্যাপককে তিন মাসের ছুটিতে পাঠিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ১১ ফেব্রুয়ারি ওই ছাত্রী লিখিতভাবে অভিযোগ দাখিল করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের স্থায়ী অব্যাহতির দাবিতে চলছে বিক্ষোভ। সেখানে ৩১ জানুয়ারি রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা করেছেন এক অধ্যাপক। এক সপ্তাহ আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে দলবদ্ধভাবে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীসহ দায়ীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখন ধর্ষণকারী ব্যক্তি ও সহায়তাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনিক ভবন অবরোধসহ আন্দোলন চলছে। অর্থাৎ বিচার দাবি ও বিক্ষোভ দৃশ্যমান হচ্ছে এসব ঘটনায়। কিন্তু বহু ঘটনা রয়েছে যেসব নৃশংস ঘটনার বিচার দাবিতে সেরকম দাবি-দাওয়া বা আন্দোলন হয় না। অথচ সমাজ-সরকার বা রাষ্ট্রের স্বার্থেই সেসব ঘটনার বিচার নিশ্চিত হওয়া জরুরি।
একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। আর এতে পেছনের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। আমরাও অবলীলায় ভুলে যাই সেসব নৃশংসতা। কিন্তু কোনো কোনো ঘটনা কখনো ভুলবার নয়! যেমন-সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার নির্মমতা। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার তারিখ শতাধিকবার পেছাচ্ছে। আর কতোদিন, কতো বছর এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষা আমাদের করতে হবে। আর কতো অপেক্ষা? বিএফইউজে, ডিইউজে, ডিআরইউ, ক্র্যাবসহ সাংবাদিক সমাজ এ আন্দোলন করতে করতে এখন ক্লান্ত! ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি রাত দুটো থেকে পাঁচটার মধ্যে সেই ঘটনা ঘটে। একযুগ অর্থাৎ গত ১১ ফেব্রুয়ারি চলে গেলো। কয়েকদিন আগে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জোর দিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ধরা হবেই খুনিদের।
গত ডিসেম্বরের কথা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন সামনে থাকায় সারা দেশে টানটান উত্তেজনা। বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি আসছে না নির্বাচনে। কী হতে যাচ্ছে? এমন প্রশ্ন সারা দেশে। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই নিষ্ঠুরতার নানা খবর আসছে। এর মধ্যে এলো ট্রেনে নাশকতার খবর। নৃশংসতার খবর। সেদিন ছিলো ১৯ ডিসেম্বর। নাশকতায় ৪ জনের মৃত্যু। রাজধানীর ঢাকা মেডিক্যালে শোকাহত মিজানুর রহমান জাতির কাছে প্রশ্ন করেছিলেন, কী অপরাধে নিহতদের জীবন নেয়া হলো এবং এই বিচার কার কাছে চাইবেন তিনি? আসলেই তার প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব নয়। কেউই পারেনি, পারবেও না। এই নিষ্ঠুরতার জবাব কী হতে পারে? তার স্ত্রী নাদিরা আক্তার ও তিন বছরের ছেলে ইয়াছিনের মরদেহ চেনার অবস্থায় নেই। নিরপরাধ মানুষ হত্যার বিচার কী ধরনের হতে পারে? ট্রেন থেকে উদ্ধার করা দেহ পুড়ে অঙ্গার। সেদিন টেলিভিশনের খবরে দেখা গেলো পুড়ে অঙ্গার হওয়া চারজনের মরদেহ সারি করে রাখা। সারি করা মরদেহগুলোর মধ্যে মিজানের স্ত্রী নাদিরা আক্তার (৩২) অন্যজন ৩ বছরের ছেলে ইয়াছিন রহমান।
দিনটি ছিলো ১৯ ডিসেম্বর। ভোর পাঁচটার পরে রাজধানীর তেজগাঁও স্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে পুড়ে তারা মারা গেছেন। এ ঘটনায় আরো দুজন নিহত হয়েছেন। তারা পুরুষ। নিষ্ঠুর এ ঘটনায় হরতাল-অবরোধকারীদের দায়ী করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান। ডিএমপি কমিশনার বলেছিলেন, আমি মনে করি যারা অবরোধ-হরতাল দিচ্ছে তারাই এই নাশকতা করেছে। এর আগেও তারা এভাবে ট্রেনে নাশকতা করেছে।
আমরা যা দেখছি, এটা কে কী আদৌ অন্দোলন বলা চলে? যেভাবে এসব শুরু হয়েছে তা কিন্তু মানুষকে আতঙ্কিত করছে। মানুষের ভরসাস্থল নষ্ট হচ্ছে। ‘কঠোর হাতে দমন করা হবে’ বলে বক্তৃতা দিয়ে মানুষকে বিশ্বাস করানো যাবে না। আর ‘লোক দেখানো’ তদন্ত কোনো কাজে আসবে না! নাশকতার এই চিত্র রাজনৈতিক সহিংসতাকে উস্কে দিতে বাধ্য। পরিস্থিতি জটিল হবে। সুতরাং, নাশকতাকারীরা কোনোরকম সুযোগ যাতে না পায় সেদিকে সতর্কতা জরুরি। নাশকতাকারীরা তো অন্যকোনো দেশ থেকে আসেনি। যারা বড়বড় কথা বলেছিলেন তারাও সেখানেই আছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কঠিন সমস্যা ছিলো জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ। কিন্তু সেটিও পেরেছি। কিন্তু নাশকতাকারীদের কিছু করতে পারি না। কেনো? কেনো পারি না? সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। হাঁ, এটা সত্য। কিন্তু খুনি-নাশকতাদের পারি না কেনো? কোথায় সমস্যা?
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) এর ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আইজিপি আরো বলেছেন, বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি কুচক্রী মহল চেষ্টা করেছিলো। প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশ পুলিশের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে তিনি আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। সেজন্য জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পুলিশ বর্তমানে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।
আইজিপির ভাষায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দায়িত্ব গ্রহণের আগে (বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকাকালে) এই দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ কীভাবে মাথাচাড়া দিয়েছিলো, সেটা আমরা দেখেছি। আমরা দেখেছি, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় চলে এসেছে। একসঙ্গে বোমা হামলা করে জঙ্গিবাদের হুলি খেলা হয়েছিলো বাংলাদেশে।
এখন কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় নেই। সুতরাং সত্য উদঘাটন দরকার। জনগণ তাকিয়ে আছে আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। আওয়ামী লীগ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করে জনগণের ম্যান্ডেটে পুনরায় ক্ষমতায় এসেছে।
হ্যাঁ সত্যি, আমরা সবাই জানি ও দেখেছি ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নজিরবিহীন ষড়যন্ত্র হয়েছে। একটা সময় বিএনপি নেতৃত্বাধীন সমমনা দলগুলো বড় বড় স্বপ্ন দেখতো। যেকোনোভাবেই হোক সরকার পতনের বিশ্বাস ছিলো তাদের। তবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে নয়-এটা বহুবার প্রমাণ হয়েছে। সরকার উচ্ছেদ করার স্বপ্ন দেখতো। চাহিদা অনুযায়ী কয়েকজন জামায়াত নেতাকে মন্ত্রী করার আশ্বাসও নাকি দেয়া হয়েছিলো। বিশ্বাস করাতে লন্ডন থেকে কথা বলিয়ে শোনানো হয় জামায়াতে ইসলামীকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি। দীর্ঘদিন পর বিএনপি এখন নিশ্চিত হয়ে গেছে, আমেরিকা মৌখিক আশ্বাস দিচ্ছে। কাজের কাজ ওরা কিছুই করবে না। নিজেদের মধ্যে নাকি বলাবলি হচ্ছে, বর্তমান সময়কে নষ্ট করেছেন বিএনপির কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা। বিভিন্ন পরিবেশ ও নানামুখী অভিজ্ঞতায় এখন বদলে যাওয়া তৃণমূলে থাকা অধিকাংশ নেতা-কর্মী মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তবে কিছু কর্মী নেতা এখনো স্বপ্ন দেখে সরকার উচ্ছেদের। কিন্তু এটা কী সম্ভব? নির্বাচন সম্পন্ন হলেও এখনো বিএনপির কিছু নেতা ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। তবে অন্যপক্ষে প্রশ্ন উঠেছে, বিএনপির কি সেই সাংগঠনিক শক্তি আছে? এ প্রশ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন নেতার। তারা এখন নাকি বিশ্বাস করেন যে, বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জনগণ নেই।
বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর প্রতিদিনের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, বিএনপি নানারকম খোয়াব দেখে চলেছে। তারা সরকার উচ্ছেদ করতে যেকোনা ঘটনা ঘটাতে পারে। আর এটাও পরিষ্কার হয়ে গেছে, আন্দোলন করে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানো অসম্ভব। এটা পরিষ্কার যে আন্দোলন থেকে বিএনপি অনেক দূরে। মূলত জনগণকে সম্পৃক্ত করা ছাড়া আন্দোলন কখনো সফল হয় না। চারদিকে যা দেখা যাচ্ছে, বিএনপি জনগণকে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। একে একে প্রমাণ হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকন্যার সিদ্ধান্তই সঠিক ছিলো। আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু বলেছেনও, প্রার্থীতা উন্মুক্ত না রাখা হলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতো।
গোপনে গাড়িতে অগুন ধরিয়ে দিয়ে, মানুষ পুড়িয়ে মেরে, আগুন জ্বালিয়ে, যাত্রীবাহী ট্রেনে আগুন ছড়িয়ে দিয়ে আন্দোলন হয় কি? হয় না। এখন জরুরি কাজটি হচ্ছে নাশকতাকারীদেও গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করতেই হবে। বড় বড় কথায় কাজ হবে না। তা যদি না হয় তাহলে, নাশকতাকারীরা অস্থিতিশীল করে তুলবে দেশকে। এটা এখনই দমাতে না পারলে দ্বিগুণ শক্তিতে তারা জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দেশের অগ্রগতি অব্যাহত রাখতেই এসব কাজ জরুরি।
লেখক: কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক ও ফিল্মমেকার
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।