রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯৭ লাখের চেয়ার-টেবিল আনতে ভাড়া সাড়ে ৫ লাখ!

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

বয়স সবে ন’বছর। কিন্তু সেই সময়ের মধ্যেই রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু আর্থিক বেনিয়ম হয়েছে বলে দাবি করেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (ক্যাগ)। রাজ্যের প্রিন্সিপাল অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের তরফে চিঠিও পাঠানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়কে। ৯ সেপ্টেম্বর পাঠানো সেই চিঠিতে যে যে ‘অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা’র অভিযোগ মিলেছে, তার জবাব চাওয়া হয়েছে। সময় দেয়া হয়েছে চার সপ্তাহ অর্থাৎ, এক মাস। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এখনও জবাব দেয়নি। উপাচার্য দীপককুমার রায় এবং রেজিস্ট্রার দুর্লভ সরকার চিঠির কথা স্বীকার করে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী এগ্‌জ়িকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকের পরে চিঠির জবাব দেয়া হবে।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়েছিল। সেই সময় থেকে, অর্থাৎ ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছর থেকে ২০২২-’২৩ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের অডিট করে ক্যাগ। গত ২২ এপ্রিল থেকে ২৪ মে পর্যন্ত চলে অডিট। এর পরে ‘ইনস্পেকশন রিপোর্ট’ তৈরি করে তা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাঠানো হয়েছে গত ৯ সেপ্টেম্বর। রিপোর্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের হিসাবে অস্বচ্ছতার অভিযোগ যেমন রয়েছে, তেমনই অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম ভেঙে বিভিন্ন সংস্থাকে কাজের বরাত দেয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছে ক্যাগ। কয়েক জন অধ্যাপকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করেছে ক্যাগ।

ওই সব অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে না চাইলেও রেজিস্ট্রার দুর্লভ বলেন, ‘‘বিস্তারিত বলতে পারবেন উপাচার্য। তবে আমরা ক্যাগকে চিঠির উত্তর পাঠাব এগ্‌জ়িকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠকের পরে। ওই বৈঠকের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ করা হবে।’’ কবে হবে সেই বৈঠক? উপাচার্য দীপককুমার বলেন, ‘‘রাজ্য সরকার বা উচ্চশিক্ষা দফতরের অনুমোদন মিললেই বৈঠক হবে। তার পরেই চিঠির জবাব তৈরি হবে।’’ তবে যে সময়কালের হিসাব নিয়ে অভিযোগ, সেটা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার আগেই বলে জানিয়েছেন উপাচার্য। দীপককুমার বলেন, ‘‘২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অগস্ট আমি উপাচার্য হিসাবে যোগ দিয়েছি। আর অডিট হয়েছে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাস পর্যন্ত খরচের।’’ একই সঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে যে দফতর, সংস্থা বা ব্যক্তিকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ইতিমধ্যেই চিঠি পাঠানো হয়েছে।

ক্যাগের রিপোর্টের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে, উপাচার্যের বাংলো এবং কর্মীদের আবাসন বানানোর ক্ষেত্রে নির্মাণকারী সংস্থাকে অতিরিক্ত ২৫.৮১ লাখ টাকা দেয়ার কথা। নিয়ম ভেঙে ৫৫ লাখ টাকা অগ্রিম দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ক্যাগ। ওই কাজের বরাত প্রথমে রাজ্য সরকার অনুমোদিত সংস্থাকে দেয়া হলেও পরে তা নিয়ম ভেঙে অন্য এক সংস্থাকে দেয়া হয় বলে দাবি ক্যাগের। বলা হয়েছে, ওই সংস্থাকে কোনও আইনি ‘ওয়ার্ক অর্ডার’ দেয়া হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয় কোনও চুক্তিও করেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের ‘প্রজেক্ট রিপোর্ট’ বানাতে ৩৭.৬৮ লাখ টাকা খরচ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে ক্যাগ। এ ছাড়াও, রাজ্য সরকারের টেন্ডার নীতি অমান্য করে কয়েকটি সংস্থাকে বারংবার বিভিন্ন কাজের বরাত দেয়া হয়েছে। যে সব ক্ষেত্রে কোনও দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়নি।

ন’বছরের বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের জন্য তিনটি মোটর গাড়ি কেনা হয়েছে। ক্যাগের দাবি, ৪৩.২৯ লাখ টাকার গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে কোনও টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়নি। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ম অনুযায়ী একটি বিলে পাঁচ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হলে ই-টেন্ডার বাধ্যতামূলক। এ ছাড়াও দু’টি দৈনিক সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দরপত্রের বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়। গাড়ির ক্ষেত্রে রাজ্যের নিয়ম জিইএম (গভর্নমেন্ট ই-মার্কেটপ্লেস) থেকেই কিনতে হবে। কিন্তু রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কোনও নিয়ম মানেনি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গাড়ি কেনার অগ্রিম দিয়ে দেয়া হয় উপাচার্যের অনুমোদন পাওয়ার আগেই। শুধু তা-ই নয়, বিশ্ববিদ্যালয় এক কোটি টাকার বেশি তথ্যপ্রযুক্তি সংক্রান্ত সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও কোনও টেন্ডার ডাকেনি। রাজ্য সরকারের নিয়ম মেনে যদিও টেকনিক্যাল ও ফিন্যানশিয়াল— দু’রকমের দরপত্রই আহ্বান করার কথা।

ক্যাগের দাবি, দরপত্র না আহ্বান করে বিভিন্ন সংস্থাকে সরাসরি আড়াই কোটি টাকার কাজের বরাত দেয়ায় কর বাবদ রাজ্য সরকারের ক্ষতি হয়েছে সাত লাখের বেশি টাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিন বানানোর ক্ষেত্রেও ২২ লাখ টাকার খরচকে ‘সন্দেহজনক’ বলেছে ক্যাগ। সিসিটিভি ব্যবস্থা, গ্রন্থাগার, স্মার্ট ক্লাসরুম বানানো কিংবা সল্টলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভাড়া নেওয়া তিন কামরার ফ্ল্যাট-সহ অনেক কিছু নিয়ে ‘অস্বচ্ছতা’র অভিযোগ রয়েছে ক্যাগের রিপোর্টে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নীতি-নিয়মের তোয়াক্কা করা হয়নি বলে দাবি। এমন নানা তথ্য দেয়ার পাশাপাশি ক্যাগের দাবি, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় ৯৭ লাখ টাকার চেয়ার-টেবিল কেনে। যা দোকান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আনতে খরচ হয়েছিল ৫.৪৮ লাখ টাকা। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিভাগের এমন বহু লাখ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে, যার যথাযথ রসিদ নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে।

এ সবের বাইরে ক্যাগের অভিযোগ, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন অধ্যাপকের পদোন্নতির ক্ষেত্রে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের নিয়ম মানা হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আচার্যের পাঠানো প্রতিনিধি ছাড়াই পদোন্নতির কমিটি তৈরি হয়। ওই এক ডজন অধ্যাপকদের মধ্যে অর্থনীতি বিভাগের সুব্রত সাহা রয়েছেন। যিনি শাসকদল তৃণমূলের অধ্যাপক সংগঠন ওয়েবকুপার উত্তর দিনাজপুর জেলার নেতা। অভিযোগের তালিকায় তাঁর নাম প্রসঙ্গে সুব্রত বলেন, ‘‘ওই রিপোর্ট আমি দেখিনি বলে কিছু বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয়, কমিটি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয় কোনও নিয়ম ভাঙেনি। তবে বিস্তারিত বলতে পারবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং এগ্‌জিকিউটিভ কাউন্সিল।’’

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037388801574707