বিদায়ী বছরে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়ায় আমদানি খরচ বেড়ে যায়। ফলে দেশের বাজারে ডলারের অস্থিরতা দেখা দেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিনিয়ত বাজারে ডলার ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর কাছে আরও ৮ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। প্রতি ডলারে ১০০ টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েও রিজার্ভের পতন ঠেকাতে পারছে না। চলতি সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) নভেম্বর-ডিসেম্বর মেয়াদের ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ৩২ বিলিয়নে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) গণনা পদ্ধতি অনুসারে তা দাঁড়াবে ২৪ বিলিয়নে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, প্রথমবারের মতো ব্যাংকগুলোর কাছে ১০০ টাকায় ডলার বিক্রি করেছে তারা। এ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ৭৬৫ কোটি বা ৭.৬৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। এর আগে ছয় মাসে রিজার্ভ থেকে এত ডলার কখনো বিক্রি হয়নি। অস্থির ডলার বাজারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন পদক্ষেপ নিয়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের পুরো সময়ে রিজার্ভ থেকে ৭৬২ কোটি (৭.৬২ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছিল তারা। ২০২০-২১ অর্থবছরে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় বাজার থেকে উল্টো প্রায় ৮০০ কোটি (৮ বিলিয়ন) ডলার কিনেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, করোনাপরবর্তী অর্থনৈতিক ধাক্কা সামাল দেওয়ার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেধে যাওয়ায় সারা বিশে^ই অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। রপ্তানির চেয়ে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডলার সংকট তৈরি হয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক আমদানির এলসিতে কড়াকড়ি আরোপ করায় খরচ অনেকটা কমেছে। গত দুই মাস ধরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দুই সূচক রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। এই ধারা ঠিক থাকলে দ্রুত দেশের ডলার সংকট আরও কাটবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে তখন আর ডলার বেচতে হবে না।
নতুন বছরের প্রথম সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে ১ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি পরিশোধ করতে হবে। আকু হলো একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল ও পাকিস্তানের মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। সংশ্নিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক দুই মাস অন্তর সুদসহ আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। দায় পরিশোধের মতো রিজার্ভ না থাকায় গত অক্টোবরে আকু থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে শ্রীলঙ্কা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রিজার্ভের পতন ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, জাইকাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে সরকার। সম্প্রতি এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) প্রতিশ্রুত ২৫ কোটি ডলার রিজার্ভে যোগ হয়েছে। নতুন বছরে আইএমএফের প্রতিশ্রুত ৪৫০ কোটি ডলার ঋণছাড় শুরুর আশা করা হচ্ছে। তবে সংস্থাটি থেকে ঋণ নিতে বাংলাদেশকে কিছু সংস্কার করতে হবে। শর্তের অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক মানদ-ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদ্ধতিতে রিজার্ভের হিসাব করতে হবে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলে জোগান দেওয়া ৭ বিলিয়ন ডলারসহ বিভিন্ন তহবিলে দেওয়া ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এতে সম্মত হয়েছে। ফলে চলতি সপ্তাহে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ নামবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঘরে।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২ জুন প্রথমবারের মতো দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। করোনার আগ পর্যন্ত রিজার্ভ ৩২ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ছিল। করোনার প্রভাব শুরু হলে বিশ্ববাজারে সুদহার অনেক কমে যায়। তখন বিশ্বের অনেক দেশ বিদেশি ঋণ কমালেও বাংলাদেশ ব্যাংক বাড়ানোর সুযোগ করে দেয়। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পথ বেছে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৪৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। করোনাপরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বেশিরভাগ জিনিসের দর বেড়েছে। এরপর রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ ছিল ৪৬ দশমিক শূন্য ৭ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুন শেষে ছিল ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। গত এক বছরে রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমেছে।