অবসরের পর শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডের টাকা পেতে পদে পদে ভোগান্তির অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এই দুই ফান্ডের টাকা পেতে বছরের পর বছর দপ্তরে দপ্তরে ঘুরতে হয় বলে বরাবরই অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন ভুক্তভোগৗ শিক্ষকরা। চাকরিকালীন সময়ে প্রতি মাসে দুই ফান্ড মিলিয়ে বেতন থেকে কেটে রাখা নিজেদের দশ শতাংশ টাকা পেতেই গলদঘর্ম হতে হয় তাদের। টাকার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে অসুস্থতাজনিত কারণে অনেক শিক্ষকের মৃত্যুও হয়েছে। সম্প্রতি দুই ফান্ডের টাকা পাওয়ার অনিশ্চয়তা আরো বেড়েছে।
একে তো বরাবরই এই দুটি ফান্ডে সারা বছরই টাকার সংকট থাকে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে ব্যাংকের তারল্য সংকট। নানা অনিয়মের কারণে সম্প্রতি অর্থনৈতিকভাবে চাপে পড়া এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও হত্যা মামলায় কারান্তরীণ আনিসুল হকের মালিকানধীন সিটিজেনস ব্যাকে কল্যাণ ও অবসর ফান্ডের অধিকাংশ টাকা জমা আছে। কিন্তু, এই দুটি ব্যাংকই বর্তমানে নিদারুণ রুগ্ন দশায় নিপতিত। গতকাল মঙ্গলবারও রাজধানীতে পাওনার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের গ্রাহকরা।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যক্তিগত লাভের আশায় রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাংক থেকে টাকা তুলে বেসরকারি ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে টাকার রাখার সিদ্ধান্ত হয় ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে। সেই থেকে অদ্যাবধি চলছে। এতে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন সাবেক শিক্ষা সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরীসহ কয়েকজন সচিব ও অবসর বোর্ডের সাবেক সচিব আসাদুল হক ও কল্যাণট্রাস্টের সচিব মো. শাহজাহান আলম সাজুসহ কয়েকজন। ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর এরা কেউ পলাতক কেউ কারাগারে। কিন্তু অনির্দিষ্টকালের ভোগান্তিতে পড়েছেন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। ব্যাংকে টাকা নেই। শিক্ষকদের বেতন থেকে যে টাকা চাঁদাবাবদ কেটে নেওয়া হচ্ছে, তা মাউশি অধিদপ্তরের ডিজির অ্যাকাউন্টে জমা হচ্ছে। গত দুই মাসে দুইশ কোটির বেশি টাকা জমা হয়েছে। কিন্তু ব্যাংকের তারল্য সংকটের কারণে টাকা ট্রান্সফার করা হচ্ছে না।
অবসরে যাওয়ার পর এককালীন কিছু আর্থিক সুবিধা পান বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। আর এই সুবিধা পেতে চাকরিকালীন তাদের প্রতি মাসের এমপিও (বেতন-ভাতার সরকারি অংশ) থেকে অবসর ও কল্যাণ ফান্ডে যথাক্রমে ৬ ও ৪ শতাংশ করে টাকা কেটে রাখা হয়। বিধান অনুযায়ী সাড়ে পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর প্রতিমাসের এমপিও থেকে চাঁদা বাবদ কর্তন করা কোটি কোটি টাকা জমা থাকার কথা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে। সেখান থেকে সুদ পাওয়া যায়। ফলে জমা টাকার মূলধন বাড়ে।
পদাধিকার বলে অবসর ও কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি শিক্ষাসচিব। আর ২১ সদস্যের কমিটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হলেন সচিব। যিনি মূলত কোনো এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ। গতমাসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাসচিব ছিলেন। ওই সময়ে তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অমান্য করে অবসর ও কল্যাণ ফান্ডের সোনালী ব্যাংকের বিভিন্ন হিসেবে জমানো প্রায় সাতশ কোটি টাকার ৯৯ শতাংশ তুলে বিভিন্ন বেসরকারি নতুন ও রুগ্ন ব্যাংকে রাখেন। যদিও অর্থ বিভাগের নির্দেশ ২৫ শতাংশের বেশি বেসরকারি ব্যাংকে রাখা যাবে না। কিন্তু, একেবারে নতুন অথবা রুগ্ন ব্যাংকে টাকার রাখায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হন কামাল চৌধুরী। সোনালী ব্যাংক থেকে বারবার তাগাদা দিলেও তাতে পাত্তা দেননি তখনকার দাপুটে শিক্ষাসচিব।
আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, রুগ্ন ব্যাংকগুলোকে সবল করতে গিয়ে শিক্ষকদের টাকাগুলো আটকে রাখা হয়। বলা হয় ফান্ড নেই। তাতে বঞ্চিত হন বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা। অবসরের পর বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও অবসর ও কল্যাণ ফান্ডের টাকা পান না তারা।
সোনালী ব্যাংক থেকে ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের সভাপতি, সহ-সভাপতি ও সচিবদের কাছে পাঠানো চিঠির কপি আমাদের বার্তার হাতে রয়েছে। এতে লেখা রয়েছে, ‘বিষয়টি গভীরভাবে পর্যালোচনায় পরিদৃষ্ট হয় যে, অত্র ব্যাংক কর্তৃক বেসরকারী ব্যাংকের অনুরূপ সুদ হার প্রদানের পরও উক্ত প্রতিষ্ঠানদ্বয় কর্তৃক অর্থ স্থানান্তরের মাধ্যম হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে পূর্বাপর বেসরকারি ব্যাংকের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে যা খুবই দুঃখজনক।’
ব্যাংকটির জেনারেল ম্যানেজার কাজী তসলিমা বানু স্বাক্ষরিত চিঠিতে আরো বলা হয়, এ প্রেক্ষিতে তহবিল সংরক্ষণ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অর্থ বিভাগের গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনাদের প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে সরকার কর্তৃক এককালীন প্রদানকৃত টাকাসহ মাসিক ভিত্তিতে প্রদেয় তহবিল অত্র ব্যাংকে সংরক্ষণের জন্য পুনরায় অনুরোধ করা হলো। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যেকোন সেবা প্রদানে শতভাগ সক্ষম সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকার কর্তৃক বরাদ্দকৃত ও অত্র ব্যাংকে জমাকৃত অর্থ থেকে সরকারি নীতিমালার বাইরে বেসরকারি ব্যাংকে অর্থ স্থানান্তরের একান্ত আবশ্যকতা দেখা দিলে সেক্ষেত্রে ব্যাংকে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং অর্থ বিভাগ বাজেট শাখা-১১ এর অনুমোদন সম্মতিপত্রসহ অর্থ স্থানান্তর বিষয়ক চেক/অনুরোধপত্র প্রেরণ করার জন্য আপনাদেরকে সবিনয় অনুরোধ করা হলো।
প্রসঙ্গত, সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী আছেন পাঁচ লাখের বেশি। এসব শিক্ষক-কর্মচারীর অবসর ও কল্যাণ সুবিধা দেওয়া হয় দুটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এর মধ্যে কল্যাণ সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে। আর অবসর সুবিধার টাকা দেওয়া হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষক ও কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের মাধ্যমে।
কিন্তু, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগের অবসর সুবিধা বোর্ডের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অফিস করছেন না। বিশেষ করে বোর্ডের সচিব শরীফ আহমদ সাদী গত ৫ আগস্ট থেকে অফিসে অনুপস্থিত। এমন পরিস্থিতিতে অবসর সুবিধা বোর্ড পুনর্গঠন জরুরি হয়ে উঠেছে।
অবসর বোর্ড সূত্র জানিয়েছে, এখনো ৩৬ হাজারের মতো আবেদন জমা পড়ে আছে। এগুলো নিষ্পত্তি করতে তিন হাজার কোটি টাকা দরকার। সর্বশেষ ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে আবেদন করা শিক্ষক-কর্মচারী কিংবা তাদের পরিবারকে অবসরের টাকা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর পর্যন্ত অডিট করে রাখা হলেও টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।
অবসর বোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন, আবেদনকারীদের কেউ খোঁজ নিতে এলে তাদের কোনোরকম বুঝিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সচিব না থাকায় খুব সংকটে আছি। চলতি সপ্তাহে সচিব একবার এসেছিলেন ঘণ্টাখানেকের জন্য। লোক জড়ো হয়ে যাওয়ায় বেশিক্ষণ অবস্থান না করেই চলে গেছেন। আবার নতুন পরিচালকও ঠিকমতো কোনো কিছু বুঝে নিচ্ছেন না। ফলে অবসর বোর্ডের কাজে এসে সবাই ঢুঁ মারছেন কল্যাণ ট্রাস্টের অফিসে।
এদিকে সরকার পরিবর্তনের পর অবসর বোর্ডের পরিচালক হন অধ্যাপক মো. জাফর আহম্মদ। অপারগতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি এ বিষয়ে তেমন কিছুই জানি না। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে জানা গেছে, ট্রাস্টে শিক্ষকদের ৩৫ হাজার আবেদন ঝুলে আছে। এগুলো নিষ্পত্তি করতেও তিন হাজার কোটি টাকা দরকার। সর্বশেষ ২০২২ এর মার্চে আবেদন করা শিক্ষকদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকেছে। তবে একই বছরের জুলাই পর্যন্ত অডিট কাজ শেষ করে রাখা হলেও টাকার অভাবে এখন নতুন করে কাউকে টাকা দেওয়া যাচ্ছে না।
ট্রাস্টের সচিব (রুটিন দায়িত্ব) মো. আবুল বাশার বলেন, সংকট সমাধানে আইবাসের মাধ্যমে টাকা ট্রান্সফারের চিন্তা করা হচ্ছে। এ ছাড়া, বাংলাদেশ ব্যাংকের পিএল অ্যাকাউন্ট খোলা হলে দ্রুত টাকা ট্রান্সফার করা সম্ভব হবে। তবে শিক্ষকদের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য যে পরিমাণ টাকা দরকার, তা এককালীন দিতে হবে। পরে যাতে সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্য প্রতি বছরের বাজেটে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে।
সূত্র বলছে, অবসর বোর্ডের টাকা রাখা হয় তিনটি ব্যাংকে। সেগুলো হলো—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসি, সিটিজেনস ব্যাংক পিএলসি এবং অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি। আর কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা রাখা হয় ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক পিএলসিতে। বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংক কিছুটা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে থাকলেও বাকি দুটি ব্যাংকে তারল্য সংকট থাকায় এসব ব্যাংকে টাকা ট্রান্সফার করতে ভয় পাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এবং পদাধিকারবলে অবসর বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ বি এম রেজাউল করীম বলেন, নতুন কমিটির জন্য উপদেষ্টার কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেটি অনুমোদন হলেই কাজ শুরু হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে এখন আছে এক হাজার কোটি টাকার মতো। এটা দিয়ে তো আমরা কিছু করতে পারব না। আমরা উপদেষ্টাকে টাকা দেওয়ার কথা বলেছি। এটি দিলে সব শিক্ষক টাকা পেয়ে যাবেন।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।