র‌্যাগিং আর কত জীবন শেষ করবে

মো. সেলিম রেজা |

র‌্যাগিংয়ের ভয়াবহতা দিন দিন যেভাবে বাড়ছে তাতে মনে হতে পারে সমাজে নতুন এক ব্যাধি ধীরে ধীরে কঠিন আকার ধারণ করছে। এ বছর রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে র‌্যাগিংয়ের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটার খবর পাওয়া যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে গেছে আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন শিক্ষার্থী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বাসায় ফেরত গেছে। শাহজালালের ছয়জন শিক্ষার্থী হয়তো কোনোভাবে আমার মতো র্যাগিং খাওয়ার পরও টিকে গেছে। এবার একটু আমার র্যাগিংয়ের অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। ২০০০ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় থাকায় মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পাই।

মৌখিক পরীক্ষার আগের রাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের খান জাহান আলী হলে এলাকার এক পরিচিত ভাইয়ের কক্ষে থাকার জন্য উঠি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমার এলাকার বড় ভাইয়ের সহায়তায় সেই রাতে আমার ওপর দিয়ে মানসিক অত্যাচারের ঝড় বয়ে যায়। আমি শুধু আমার এলাকার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি একটু সাহায্যের আশায়। কিন্তু দেখলাম তিনিও অনেক আনন্দ পাচ্ছেন আমাকে নির্যাতন করে। সে সময় তাঁরা আমাকে নারায়ণগঞ্জের পতিতালয় নিয়ে যে কথাগুলো বলেছিলেন এবং তাঁদের যে আচরণ ছিল, তাতে আমার মনে হয়েছে তাঁদের এ ধরনের কোনো এক জায়গায় জন্ম হয়েছে। তাঁরা কোনোভাবেই ভালো পরিবারের সন্তান হতে পারেন না। পরের দিন যে ভবনে মৌখিক পরীক্ষা ছিল, সেই ভবনের পরিস্থিতি আরো ভয়ানক। যারা বাসা থেকে সরাসরি মৌখিক পরীক্ষা দিতে এসেছিল তাদের ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে র্যাগিং দিচ্ছিল। ছেলে-মেয়ে এত বিকৃত রুচির হতে পারে তা আমি সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিলাম।

সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত আমি সেই রাতের কথা ভুলতে পারিনি। ভর্তির সুযোগ পেয়েও আমি আর খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হইনি। ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটে যখন আমি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য যাই। এখানেও আমি এলাকার এক বড় ভাইয়ের কক্ষে উঠি (শাহ পরান হল)। বড় ভাই আমাকে তাঁর সিট ছেড়ে দিয়ে অন্য কক্ষে গিয়ে থাকলেন। উনিই আমাকে থাকার জন্য মেস ঠিক করে দিলেন। মেসের আরেক বড় ভাই আমাকে টিউশনি ঠিক করে দিলেন। এ মেসে ওঠার তৃতীয় দিনে সকাল ৮টায় ক্লাসে যাব; কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আমার কাছে ছাতা ছিল না আবার এত ভোরে কাউকে যে ডাকব সে সাহসও পাচ্ছিলাম না। যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছিল ছাতা ছাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। শেষমেশ সাহস করে এক বড় ভাইয়ের কক্ষে নক করলাম এবং আমার সমস্যার কথা বললাম। উনি রাগের পরিবর্তে খুশি হয়ে ছাতা দিয়ে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দিলেন।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ও মাস্টার্স করার সময়ে বড় ভাই ও বোনদের কাছ থেকে যে সাহায্য-সহযোগিতা ও ভালোবাসা পেয়েছি, তা কোনো দিন শোধ করার মতো নয়। তাঁদের সঙ্গে দেখা হলে বা কথা হলে শ্রদ্ধায় এমনিতেই মাথা নত হয়ে আসে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার খুব কাছের একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনারা র্যাগিং কেন দেন। উনি উত্তরে আমাকে বলেছিলেন র্যাগিংয়ের মাধ্যমে সিনিয়র ও জুনিয়রের মাঝে নাকি সম্মানের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমি এই উত্তরের যৌক্তিকতা খুঁজে পেলাম না। যাকে আপনারা র্যাগিং দিয়ে মানসিক রোগী বানিয়ে দিচ্ছেন তার সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে উঠবে, তা আমার বোধগম্য হয় না।

গত বছর আমি পড়ালেখার জন্য কানাডায় আসি। এখানে একজন বিদেশি শিক্ষার্থীকে সার্বিক সহযোগিতা ও সাহায্য করার জন্য ছাত্র-ছাত্রীকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। তারা কিন্তু র‌্যাগিংয়ের পরিবর্তে সাহায্য-সহযোগিতা করার মাধ্যমে একটি ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী বলেছিলেন র্যাগিংয়ের মাধ্যমে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়, তিনি আমার এক বছর আগেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন। তিনি এখানে বাঙালি কমিউনিটির কাছে অত্যন্ত প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষ। তিনি এই সম্পর্ক তৈরি করেছেন আমাদের র্যাগিং দিয়ে নয়, বরং নতুন হিসেবে আমাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে।

সমাজের এই নতুন ব্যাধি নিয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। আজ একজন দিনমজুর থেকে শুরু করে কোটিপতি সবাই অনেক আদর-যত্ন ও আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সন্তানকে বড় করে। আর যে ছেলে বা মেয়েটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় সে নিশ্চয়ই ভালোর মধ্যে ভালো। কোনো পরিবার বা শিক্ষার্থীর আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি কিছু বখাটে ছেলে-মেয়ের হাসিঠাট্টায় নিমেষে শেষ হয়ে যায়, তাতে এটি সমাজ ও জাতির জন্য চরম অশনিসংকেত। এর মাধ্যমে একজন সুস্থ সবল মানুষকে মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীতে পরিণত করা হচ্ছে। সারাটা জীবন তাকে ও তার পরিবারকে এ কষ্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হবে। কী দোষে? কী অপরাধে তার এ শাস্তি? বিনা দোষে এবং বিনা অপরাধে একজন শিক্ষার্থীকে এ ধরনের নির্যাতন করার অধিকার তাদের কেউ দেয়নি। এ ধরনের অপরাধের শাস্তি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে তাদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রত্যেক শিক্ষকের উচিত র্যাগিংয়ের ভয়াবহতা নিয়ে ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করা। তাদের বোঝাতে হবে সম্পর্ক উন্নয়নে এটি কোনো ভালো পথ নয়। ওপরপর্যায়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে হবে প্রথম বর্ষে ভর্তি পরীক্ষা থেকে শুরু করে ভর্তি হওয়া এবং প্রথম বর্ষে ক্লাস করার সময় নবীনরা এমনিতেই ভয় ও আতঙ্কে থাকে। মা-বাবা ও পরিবারের জন্য মন কাঁদে। এ সময় তাদের কাছে সাহায্যের হাত বাড়াতে হবে। তাদের বুদ্ধি, তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করতে হবে। প্রতিটি বিভাগে এবং হলগুলোতে শিক্ষকদের নজরদারি বাড়াতে হবে। তবেই আমরা একটি শক্তিশালী ভালোবাসার বন্ধনের সমাজ বা বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষার পরিবেশ পাব।

প্রশাসনকে এখানে পূর্বপ্রস্তুতি ও পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রশাসনকে প্রচারণা চালাতে হবে ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরুর প্রথম দিন থেকেই। লিফলেট বিতরণ, পোস্টার, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে র্যাগিংয়ের ভয়াবহতা ও শাস্তি সম্পর্কে প্রচারণা চালাতে হবে। এর পরও কোনো ঘটনা ঘটে গেলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আর দুঃসাহস না দেখায় এ ধরনের জঘন্য অপরাধ করার।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029499530792236