লেকহেড স্কুল শিক্ষার্থীদের অন্য স্কুলে ভর্তির পরামর্শ মন্ত্রণালয়ের

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক: |

জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে বন্ধ হওয়া রাজধানীর লেকহেড গ্রামার স্কুলের প্রায় দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী কোথায় যাবে তা নিয়ে চিন্তিত অনেকেই। জঙ্গি-সংশ্নিষ্টতার অভিযোগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে গত মঙ্গলবার ঢাকা জেলা প্রশাসন প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করে দেয়। তাদের দ্রুত অন্য স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। তারা জানান, অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে চাইলে বা কোনো প্রতিষ্ঠান এই শিক্ষার্থীদের ভর্তি নিতে না চাইলে মন্ত্রণালয় থেকে সহায়তা দেওয়া হবে।

এদিকে, স্কুলটি খোলার অনুমতি চেয়ে মালিকপক্ষ গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করে। আদালত গতকালই রিটের শুনানি শেষে ‘শিগগিরই কেন স্কুল খুলে দেওয়া হবে না’ এবং ‘বন্ধের আদেশ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না’ তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। আগামী রোববার এ রুলের ওপর শুনানি হবে।

লেকহেড গ্রামার স্কুলের অধ্যক্ষ জেনিফার আহমেদ জঙ্গি কার্যক্রমে পৃষ্ঠপোষকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদে উৎসাহ জোগানোসহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্‌রীরের অন্যতম সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম মাওলার স্ত্রী। এ ছাড়া স্কুলের ১২ জনের বেশি শিক্ষকের জঙ্গি কানেকশন সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গোয়েন্দা সংস্থার

প্রতিবেদনের আলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুসন্ধান শেষে গত সোমবার প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়। মঙ্গলবারই জেলা প্রশাসন আদেশ কার্যকর করে। ঢাকা জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট ইলিয়াস মেহেদী স্কুলে গিয়ে সিলগালা করে দেন। তিনি বলেন, ‘এখন থেকে স্কুলটি কোনো ধরনের কার্যক্রম চালালে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।’

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে উৎকণ্ঠা :ডিসেম্বর থেকে এ স্কুলের শিক্ষার্থীদের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। এখনও পাঠ্যক্রমও সম্পন্ন হয়নি ছাত্রছাত্রীদের। স্কুলের সব শাখা এভাবে আকস্মিক বন্ধ করে দেওয়ায় উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

স্কুলের প্রশাসনিক কর্মকর্তা আসিফ ইশতিয়াক বলেন, ‘হঠাৎ করেই স্কুল বন্ধ করে দেওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা উৎকণ্ঠায় পড়েছেন। ডিসেম্বরের শুরুতে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। তাই দুশ্চিন্তা বেশি।’ শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রতিষ্ঠানের কোনো সরকারি অনুমোদন নেই বললেও তিনি দাবি করেন, তারা সরকারি নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান। আগামী ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের নিবন্ধনের মেয়াদ রয়েছে।

তার এ বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক অধ্যাপক এ টি এম মইনুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, লেকহেড গ্রামার স্কুলটি অননুমোদিত প্রতিষ্ঠান।

বারবার মালিকানা বদল : অনুসন্ধানে জানা গেছে, লেকহেড গ্রামার স্কুলের মালিকানা গত দুই বছরে দু’বার বদল হয়েছে। ২০০৬ সালে চালু হওয়া এ স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা জঙ্গিবাদে অভিযুক্ত রেজোয়ান হাসান ও তার স্ত্রী জেনিফার আহমেদ হলেও তারা এখন আর প্রতিষ্ঠানটির মালিকানায় নেই। গত বছরের শুরুতে সাবিত্রি আহমেদ শোভা নামের একজন ব্যবসায়ী এ বিদ্যালয়ের মালিকানায় আসেন। চলতি বছরের মার্চ মাসে আরএম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী খালেদ হাসান মতিন বিদ্যালয়টি কিনে নেন। আরএম গ্রুপ নির্মাণসামগ্রীর ব্যবসায় সম্পৃক্ত। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় বনানীর ৬ নম্বর সড়কের ১২ নম্বর বাড়িতে। গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে আরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপক সাব্বির আহমেদ জানান, লেকহেড গ্রামার স্কুলটি তাদের গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। মার্চে তারা প্রতিষ্ঠানটি কেনার সময় জানতেন না, এর প্রতিষ্ঠাতারা জঙ্গিবাদে জড়িত।

প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান খালেদ হাসান মতিনের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তার কর্মচারীরা নানা বাহানায় কথা বলতে দেননি।

সরেজমিনে স্কুলের প্রধান শাখা :লেকহেড স্কুলের প্রধান শাখা ধানমণ্ডির ১১/এ নম্বর সড়কের ৭৮ নম্বর বাড়িতে। গতকাল দুপুরে সেখানে গিয়ে দু’জন নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আর বাবু জানান, প্রশাসন থেকে সিলগালা করে দেওয়ার পর অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের কেউ আর আসেননি। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর নাসিমা খান নামের একজন অভিভাবককে আসতে দেখা যায়। তিনি জানতে চান, স্কুল কবে থেকে শুরু হবে? দুই নিরাপত্তাকর্মী তাকেও কিছু জানাতে পারেননি। সঙ্গে আলাপকালে নাসিমা খান বলেন, স্কুল বন্ধ হওয়ার পর কর্তৃপক্ষ একটি নোটিশ পর্যন্ত টাঙায়নি। তিনি পত্রিকা পড়ে ও টেলিভিশনের স্ট্ক্রল দেখে জেনেছেন, এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, সামনে পরীক্ষা। সব শিক্ষার্থী ও অভিভাবক তাই উদ্বিঘ্ন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ধানমণ্ডির এই প্রধান শাখায় প্লে থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় এক হাজার ৩০০ ছাত্রছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক কতজন, তা নিশ্চিত করতে পারেননি কেউ। নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, স্কুলের স্বত্বাধিকারী খালেদ হাসান মতিন মাঝেমধ্যে আসেন। তবে বন্ধ হওয়ার পর আসেননি।

গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বরের কাছেই ১৩৫ নম্বর সড়কে এসইবি ৬ নম্বর বাড়িতে লেকহেড গ্রামার স্কুলের গুলশান শাখা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক বন্ধ। অনেক ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে বের হন নিরাপত্তাকর্মী সুরুজ আলী। তিনি জানান, ভেতরে তিনিসহ তিনজন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষকদের কেউ আসছেন না। স্কুলটির গুলশান শাখায় প্লে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ছে বলে জানান তিনি। সাড়ে তিনতলা এ ভবনের নাম ‘বিয়ানীবাজার ভবন’। এর মালিক প্রয়াত এস কে ওয়াহিদুর রহমান। স্কুলের পাশের প্লটেই কমিউনিটি সেন্টার ‘ইমানুয়েলস’। এ সেন্টারের কর্মী রাজীব জানান, স্কুলটি মঙ্গলবার বন্ধ হয়ে গেছে। তারা শুনেছেন, সেখানে কেউ কেউ জঙ্গিবাদে জড়িত।

শিক্ষার্থীদের অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে সহায়তা দেবে মন্ত্রণালয় :লেকহেড গ্রামার স্কুলের শিক্ষার্থীদের অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া অব্যাহত রাখার পরামর্শ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তাও দেবে সরকার। ‘বন্ধ হওয়া এ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এখন কী হবে’- জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদ গতকাল দুপুরে  এ তথ্য জানান।

মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মাধ্যমিক) সালমা জাহান  বলেন, শিক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হতে দেওয়া হবে না। তাদের স্বার্থ সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করা হবে।

ইংরেজি মাধ্যমের এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পর সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ জানতে চাইলে অতিরিক্ত সচিব (বেসরকারি মাধ্যমিক) জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘ইংরেজি মাধ্যমের এই স্কুল সরকারি নিয়মনীতিতে পরিচালিত হতো না। অনুমোদনহীনভাবে পরিচালিত এ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় এর কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ?’শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান, তাদের নিজেদের সুবিধামতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যেতে হবে। যারা লেখাপড়া করছে, তাদের কোনো দোষ নেই। প্রতিষ্ঠানের অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আদালতে রিট আবেদন :এদিকে, স্কুলটি বন্ধের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে তিনটি রিট আবেদন করা হয়েছে। ওই স্কুলের ১২ শিক্ষার্থীর অভিভাবক এবং মালিক খালেদ হাসান মতিনের পক্ষে আইনজীবী রাশনা ইমাম গতকাল বৃহস্পতিবার এ রিট আবেদন করেন। রিটকারী পক্ষের অন্য আইনজীবীরা হলেন- এ এফ হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার আখতার ইমাম ও রাশনা ইমাম।

রাশনা ইমাম সাংবাদিকদের বলেন, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চে দুপুরের পর এ শুনানি হয়।

রিটের শুনানিতে হাইকোর্ট বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কাজ করবে কেন? তারা অভিযোগ দেবে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এগুলো দেখবে। এখানে (ওই প্রতিষ্ঠানে) ১১শ’র ঊর্ধ্বে শিক্ষার্থী আছে। তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে? হঠাৎ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করবে কেন?’

আদালত শিগগিরই কেন স্কুল খুলে দেওয়া হবে না এবং বন্ধের আদেশ কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেন। শিক্ষা সচিবসহ সংশ্নিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha ট্রেনে কাটা পড়ে স্কুলশিক্ষকের মৃত্যু গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা কাল শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষকরাই স্মার্ট নাগরিক গড়ার কারিগর: শিল্পমন্ত্রী এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha এনটিআরসিএর সার্টিফিকেট সংশোধনের নতুন নির্দেশনা মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা - dainik shiksha মর্নিং স্কুলের ছয় সুবিধা উল্লেখ করলেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023458003997803