শরীফ থেকে শরীফা, অতঃপর বিতর্ক

অধ্যাপক ড. মো. লোকমান হোসেন |

মানুষের শরীরে থাকা প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে ২২ জোড়া হলো অটোজোম এবং এক জোড়া হলো সেক্স ক্রোমোজোম। অটোজোম দেহগঠন ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ এবং সেক্স ক্রোমোজোম লিঙ্গ নির্ধারণে ভূমিকা পালন করে থাকে। স্ত্রীদেহে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম হলো দুটি এক্স ক্রোমোজোম, অপরদিকে পুরুষদেহে লিঙ্গ নির্ধারক ক্রোমোজোম দুটি হলো এক্স এবং ওয়াই। জাইগোট পরবর্তী কোষ বিভাজনকালে বাবা-মা উভয়ের কাছ থেকে কোনো ভ্রূণে এক ধরনের ক্রোমোজোম অর্থাৎ যদি এক্স এক্স যৌন ক্রোমোজোম আসে তাহলে ওই শিশুটি হবে মেয়ে এবং মায়ের কাছ থেকে এক্স ও বাবার কাছ থেকে ওয়াই যৌন ক্রোমোজোম এলে ওই শিশুটি হবে ছেলে। ভ্রূণের পূর্ণতার স্তরগুলোতে ক্রোমজোমের প্যাটার্নের প্রভাবে ছেলে শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ আর কন্যা শিশুর মধ্যে ডিম্বাশয় জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন টেস্টোস্টেরন ও এন্ড্রোজেন, আর ডিম্বাশয় থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজেন, যা দেহের সেকেন্ডারি সেক্স বৈশিষ্ট্যসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে। ভ্রƒণসৃষ্টি পর্যায়ে জননকোষের নিষিক্তকরণ ও বিভাজনের সময়ে অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সৃষ্টি হলে, যেমন-এক্স এক্স ওয়াই অথবা এক্স ওয়াই ওয়াই ক্রোমোজোম সন্নিবেশিত হলে সন্তানটি হবে হিজড়া। এ পর্যায়ে শিশুটির পিতামাতার কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এক্ষেত্রে কিছু ছেলে বা মেয়ে বিপরীতধর্মী আচরণ করে এবং বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার একটি পর্যায়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ কমে সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় হরমোনের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে ধীরে ধীরে ট্রান্সজেন্ডার বা হিজড়ায় পরিণত হয়, যাদেরকে আমরা তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে জানি। 

হিজড়ারা জন্মগতভাবেই একাধারে স্ত্রী ও পুংলিঙ্গ সংবলিত বা উভয়লিঙ্গ। তবে প্রতিটি লিঙ্গই অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট। নারীও নয় আবার পুরুষও নয়- এ ধরনের একটি শ্রেণিকে নারীবেশে সেজেগুজে আমরা প্রায়ই রাস্তাঘাটে বিভিন্ন রকম অঙ্গভঙ্গি করে চলতে দেখি। আমরা এই অবহেলিত শ্রেণিটিকে ‘হিজড়া’ বলে ডাকি। 

হিজড়া শব্দটি এসেছে আরবি হিজরত শব্দ থেকে যার আভিধানিক অর্থ পরিবর্তন। লিঙ্গ নির্ধারণের সময়ে শারীরবৃত্তীয় ত্রুটির কারণে এদের সৃষ্টি। এদের প্রধান সমস্যা হলো, এদের লিঙ্গে নারী বা পুরুষের নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য থাকে না। ইসলাম ধর্ম অন্যসব মানুষের মতো হিজড়াদেরকেও একজন মানুষ হিসেবে দেখছে। তারা পুরুষ হলে পুরুষের, নারী হলে নারীর বিধান মেনে চলবে। একজন নারীর যেমন নামাজ, রোজা ও পর্দাসহ ইসলামের সব বিধানকে মানতে হয়, একজন নারী হিজড়াকেও এগুলো মেনে চলতে হবে। একইভাবে পুরুষ হিজড়াকেও পুরুষের মতো ইসলামি অনুশাসন মেনে চলতে হবে। 
প্রতিবন্ধী মানুষের যেমন শারীরিক ত্রুটি থাকে, হিজরাদেরও তেমন কিছু শরীরবৃত্তিয় ত্রুটি থাকে। এ ত্রুটির কারণে তাদেরকে মনুষ্য সমাজ থেকে বের করে দেয়া যাবে না। বরং অন্যান্য প্রতিবন্ধীদের মতোই তারা স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখে। তাদের প্রতি ঘৃণা নয়-ভালোবাসা ও স্নেহ দরকার। তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, তাদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করা কাম্য নয়। গুরুত্বহীনতায় সমাজের যেকোনো মানুষ ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্নতাবাদীতে পরিণত হয়ে নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে। যৌন-বৈচিত্র্যের ভিত্তিতে পৃথিবীতে মোট চার ধরনের হিজড়ার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ক. পুরুষ, তবে নারীর বেশে চলে, তাদের আকুয়া বলে। এরা মেয়েদের বিয়ে করতে পারে। খ. নারী, এরা নারীর বেশে চলে, তবে দাড়ি-মোঁচ আছে, তাদের জেনানা বলে। তারা পুরুষের কাছে বিয়ে বসতে পারে। গ. লিঙ্গহীন যে বেশে থাকুন না কেনো তাদের খুনসায়ে মুশকিলা বলে। এরা কোনো লিঙ্গের সে বিষয়ে চিকিৎসক সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। ঘ. কৃত্রিমভাবে যৌনক্ষমতা নষ্ট করে বানানো হিজড়া, যারা খোজা নামে পরিচিত। হিজড়াদের শারীরিক গঠন মূলত ৩ প্রকার: ক. নারীদের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও নারী জননাঙ্গ থাকে না খ. পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্য থাকলেও পুরুষ জননাঙ্গ থাকে না গ. উভয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। 

একজন মানুষ হিসেবে হিজড়াদেরও কামনা-বাসনা সবই রয়েছে। অন্য আর দশজন নারী-পুরুষের মতো তাদেরও বিয়ে করার অধিকার রয়েছে। তারা যদি বিয়ে করে, এটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে আমাদের সমাজ। সমকামিতা এবং রূপান্তরকামিতা সংখ্যালঘু যৌনপ্রবৃত্তির অংশ। তথ্যমতে প্রতিটি দেশেই গড়পড়তা দশ ভাগের মতো লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল ও ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করে। গবেষকদের মতে বাংলাদেশে সমকামীর সংখ্যা ৬০ লাখ থেকে ১ কোটি ২০ লাখ। এর উল্লেখযোগ্য অংশই হচ্ছে হিজড়া জনগোষ্ঠী। অথচ দেশে তাদের অস্তিত্ব সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করা হয়।     

২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশের মন্ত্রিসভা হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ এপ্রিল ভোটার তালিকা নিবন্ধন ফরমের (ফরম-২) ক্রমিক নম্বর ১৭ সংশোধন করে লিঙ্গ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ‘পুরুষ’ ও ‘মহিলা’র পাশাপাশি ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ায় একই সঙ্গে তাদের সাংবিধানিক অধিকারও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। 

তৃতীয় লিঙ্গের সাংবিধানিক স্বীকৃতি পাওয়ায় হিজড়ারা সমাজ বিনির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। শুধু স্বীকৃতি দিলেই হবে না, রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তাদেরকে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। করুণা নয়, দক্ষতার ভিত্তিতেই তারা কাজের সুযোগ চান। হিজড়ারা চাঁদাবাজি করে মিডিয়ায় এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু তাদের দুর্ভোগের কথা কেউ তুলে ধরে না। তারাও মানুষ! তাদেরও সমাজে বেঁচে থাকার এবং চলাফেরা করার অধিকার রয়েছে। অথচ রাষ্ট্রের কোথাও তাদের স্থায়ী কোনো বাসস্থান নেই। কেউ তাদের ভালো চোখে দেখে না। বাড়ির মালিক তাদের বাসা ভাড়া দিতে চান না। কোনো প্রতিষ্ঠানেই তাদের চাকরির সুযোগ দেয় না। খেলতে গেলে কেউ তাদেরকে খেলতে নেয় না। সবাই হাসিঠাট্টা করে। 

এ সম্প্রদায় সম্পর্কে আমাদের মন-মগজে এক নেতিবাচক বদ্ধ ধারণা বিদ্যমান রয়েছে। সৃষ্টিগতভাবে অনেক মানুষের হাত নেই, পা নেই, কেউ চোখে কম দেখে, কেউ কানে কম শোনে, কেউ কথা বলতে পারে না, কারো বুদ্ধি কম, তবু এরা সবাই এক আল্লাহর সৃষ্টি। এদেরকে আমরা প্রতিবন্ধী বলি। কিন্তু অবহেলায় ফেলে দেই না। বরং বেশি আন্তরিক হই। হিজড়ারাও এক ধরনের প্রতিবন্ধী, ইসলামের সকল হুকুম-আহকাম জানার-মানার অধিকার ও দায়িত্ব তাদেরও রয়েছে। ইসলাম হিজড়াদেরকে গুরুত্বহীন মনে করে না বিধায় সম্পদ বন্টনের ক্ষেত্রে তাদের জন্য পরিষ্কার নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। 

লিঙ্গ প্রতিবন্ধীরা আমাদের সভ্য সমাজেরই কারো না কারো সন্তান। তাদেরও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে দিতে হবে। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতোই তারাও বড় হবে, শিক্ষা লাভ করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। আমাদের নবী যখন আরব ভূমিতে আগমন করেন তখন আরবের ঘরগুলোতে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া লজ্জার ছিলো। কিন্তু ইসলাম যখন কন্যা সন্তানের মর্যাদা ঘোষণা করলো তখন নারী সমাজে মর্যাদাশীল হয়ে উঠলো। লিঙ্গ প্রতিবন্ধীতা নিয়ে জন্মানোয় লজ্জার কিছু নেই। তাকে সুস্থভাবে লালন-পালন করাই হবে গৌরবের বিষয়। আমাদের দেশে নারী আছে, পুরুষ আছে এবং তৃতীয় লিঙ্গ আছে এটা আমাদের গৌরব। বাংলাদেশ সরকার একটি সুন্দর হিজড়া সমাজ গড়ে তোলার জন্য নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ আইন কমিশন সুপারিশকৃত বৈষম্য বিলোপ আইন ২০১৪ প্রণয়ন করেছে। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বারের মতো হিজড়া শিশুদের জন্য শিক্ষা উপবৃত্তি ও প্রশিক্ষণ-এর ওপর পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে মিলে অন্যান্য সংস্থা ও সংগঠন বাস্তবসম্মত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। 

হিজড়াদের একটা অংশ ভিক্ষাবৃত্তি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, বকশিশ তোলা ইত্যাদি কর্মে লিপ্ত। এই কাজগুলো করার জন্য সাধারণত তারা নানা কৌশল বেছে নেয়। হিজড়া দলের প্রলোভনে পড়ে অনেক মানুষ নিজের লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়াদের দলে যোগ দেয়। চক্রটি সরলমনের সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির সুন্দর ছেলেদের ফুসলিয়ে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অজানা কোথাও নিয়ে যায়। পরে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে ডাক্তারের মাধ্যমে পুরুষাঙ্গ কেটে, ওষুধ খাইয়ে বা অপারেশন করে শরীরের অঙ্গ বিকৃত করে বা হরমোন ইনজেকশন নিয়ে স্তন বড় করে এদের হিজড়ার খাতায় নাম লেখায়। অসচেতনতা, অর্থ উপার্জন এবং অভাব একাজকে ত্বরান্বিত করছে। 

হিজড়া মানেই বড় কোনো সমস্যা নয়। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। হিজড়া-বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মানো কোনো শিশুর পরিণত বয়সে যাওয়ার আগে চিকিৎসা করানো গেলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাকে সুস্থ করা সম্ভব। আধুনিক প্লাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে যৌনাঙ্গ প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কলকাতাসহ ভারতের বেশ কয়েকটি শহরে এই ধরনের সার্জারি করা হয়ে থাকে। চিকিৎসার পরিভাষায় এই অস্ত্রোপচারকে জেনিটাল সার্জারি বলা হয়। জেনিটাল সার্জারির মাধ্যমে কোনো মানুষের বর্তমান লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটানো হয়। বাংলাদেশে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে যৌনাঙ্গে অসংগতির চিকিৎসা চলছে। গত কয়েক বছর ধরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই অস্ত্রোপচার হচ্ছে। যদিও এই হাসপাতালে নামমাত্র মূল্যে বা বিনামূল্যে চিকিৎসার সুযোগ আছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের অভিমত হলো, শিশুকালে সচেতন থাকলে অনেক ক্ষেত্রে হিজড়া সমস্যার আরোগ্য সম্ভব। তবে মানুষের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছে না। 

ভারতের অমলা হিজড়া ছিলো অপূর্ব সুন্দরী। সে স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারতো, কেউ তাকে বুঝতে পারতো না। একদিন সে গ্রামের একটি বিয়েতে যায়। সেখানে তাকে দেখে গ্রামের এক যুবক, যার নাম কার্তিক। পরে সে তাকে বিয়ে করতে চায়, কিন্তু অমলা তার সমস্যার জন্য কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না। তবে কার্তিকও নাছোড়বান্দা, পিছু হটবার পাত্র নয়। শেষ পর্যন্ত আর কোনো উপায় না পেয়ে তাকে আসল ব্যাপারটি জানায়। জানার পরও তাকে বিয়ের ব্যাপারে পিছু হটে না কার্তিক। তার যুক্তি, শরীরের চেয়ে মনের ভালোবাসা অনেক বড়, তাই সে তাকে বিয়ে করবেই। এরপর অমলার পরিবারের সহযোগিতায় তাদের বিয়ে হয়। কিন্তু কার্তিক সমাজ ও তার পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়। তাদের বিয়ের পর বেশ কিছুদিন গেলে কার্তিক একদিন পত্রিকা দেখে জানতে পারে এরকম একটি শিশু চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়েছে। এটা জানতে পেরে সে অমলাকেও সেখানে নিয়ে যায়। ডাক্তার অমলাকে দেখে জানায় এই বয়সে এটা চিকিৎসার মাধ্যমে সফল হওয়া অসম্ভব। কিন্তু কার্তিকের পীড়াপীড়িতে ডাক্তার তার সমস্যাটি দেখেন এবং অমলার অপারেশনের উদ্যোগ নেন। অস্ত্রোপচারের পর অমলা একজন সম্পূর্ণ নারীতে পরিণত হন এবং পরবর্তীকালে তিনি সন্তানের জন্মও দেন। এ ব্যাপারে সেই ডাক্তারের অভিমত হলো, প্রকৃত অর্থে অমলার ত্রুটিটি ছিলো খুবই সামান্য এবং তার মধ্যে নারী-বৈশিষ্ট্য প্রকটভাবে বিদ্যমান ছিলো। 

ভারতীয় উপমহাদেশে ট্রান্সজেন্ডারাই মূলত হিজড়া নামে পরিচিত। ট্রান্সজেন্ডার হলো তারা, যাদের দৈহিক বা শারীরিক লিঙ্গের সঙ্গে মনোলিঙ্গের কোনো সামঞ্জস্য নেই। ট্রান্সজেন্ডাররা এক ধরনের দেহ ও আরেক ধরনের মন নিয়ে জন্মায়। মানে, ট্রান্সজেন্ডার ছেলেরা শরীরের দিক থেকে ছেলে হলেও তাদের মস্তিষ্ক থাকে মেয়ের। আবার মেয়েরা শরীরের দিক থেকে মেয়ে হলেও তাদের মস্তিষ্ক থাকে ছেলের। এই ছেলেগুলো শারীরিকভাবে ছেলে হবার পরও মানসিকভাবে মেয়ে হবার কারণে তাদের মধ্যে মেয়েলি হাবভাব থাকে, তারা নিজেদেরকে মেয়ে ভাবে। 

হিজড়ারা মূলত তাদের আপনজন বা বাবা-মা বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থাকতে পারে না। তাদের প্রত্যকের দলে থাকা গুরুকেই তারা অভিভাবক হিসেবে মানে। তাদের আয়ের টাকা গুরুমায়ের নিকট জমা দিতে বাধ্য। তারা যখন দলে যোগ দেয় তখন গুরু তাদের আগের পোশাক ফেলে দিয়ে থেকে শাড়ি পরিয়ে দেন এবং তাদের কপালে আশীর্বাদস্বরূপ আঁচল ছুঁয়ে দেন আর মন্ত্র পড়ে ফুঁক দেন, এটাকে তারা বলে রাখিবন্ধন। এরপর তারা তার অধীনেই চলে, গুরুমা যা বলেন তাহাই তারা করতে বাধ্য। হিজড়ারা অনেকেই মুসলিম হলেও তারা অনেক হিন্দুরীতিতে বিশ্বাস করে। তারা মনে করে তাদের পুনর্জন্ম হবে। কোনো হিজড়া মারা গেলে তার শেষকৃত্য খুবই গোপনীয়তার সঙ্গে করা হয়। 

কাজল হিজড়া বলেন, ‘আজ হিজড়া হওয়ার কারণে গাড়িতে মানুষ আমার পাশে বসে না, আমি বসলে তারা উঠে চলে যায়। আমি একটা ভালো বাসা ভাড়া নিতে পারি না। আমি তো মানুষ। আমার ইচ্ছা করে আমার বাবা-মা, আমার পরিবারের সঙ্গে থাকতে। আমার বাবা-মা আমাকে রাখতে চায়, কিন্তু সমাজের মানুষের কথার ভয়ে তারা আমাকে তাদের কাছে রাখে না। আমার মনে খুব কষ্ট। হিজড়াদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেসব গবেষণা হচ্ছে, সেখানেও এই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হচ্ছে, বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও স্বীকৃতির ফলে হয়তো তারা সামাজিক সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারবে, কিন্তু হিজড়াদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে তাদেরকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার সময়টা আরো দীর্ঘায়িত হবে। 

মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে তৃতীয় লিঙ্গের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিলো তা তুলে নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষমতার আসার পরই সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। এক বিবৃতিতে হোয়াইট হাউজ জানায়, লিঙ্গ পরিচয়ের ভিত্তিতে কেউ সুবিধাবঞ্চিত হবে বা কাজের সুযোগ হারাবে এমন ব্যবস্থা থাকবে না। 

হিজড়া জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হতে হলে রাষ্ট্রীয় আইনকানুন পরিবর্তনের পাশাপাশি তাদের নিজেদেরও মন-মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা সুযোগ পেলে তারাও সমাজের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। এখনই সময় তাদের অধিকার ফিরিয়ে দেবার, সামাজিক মর্যাদা দেবার, সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করার। আমাদের সকলেরই জানা ও বোঝা উচিত যে, তারা শারীরিক প্রতিবন্ধীর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। সরকারের উচিত তাদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা ও এর বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা। তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রশাসন ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আলাদা করে কোটার ব্যবস্থা করা উচিত। জনসচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন, যাতে তাদেরকে অন্যভাবে দেখা না হয়। এজন্য সরকার-এনজিও-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-মিডিয়া সবার এগিয়ে আসা উচিত। মানুষ তাদেরকে সমাজে সুস্থ সুন্দরভাবে জীবন যাপন করতে দিবে এবং তাদের সরল দৃষ্টিতে দেখবে এটাই প্রত্যাশিত।

লেখক: সাবেক মহাপরিচালক, নায়েম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা  

শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত - dainik shiksha প্রাথমিকের সাড়ে ৬ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হাইকোর্টে স্থগিত আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি - dainik shiksha আন্দোলন স্থগিত তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের, ৭ দিনের মধ্যে কমিটি পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha পাঠ্যবই নির্ভুল করা হচ্ছে: গণশিক্ষা উপদেষ্টা আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির - dainik shiksha আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি মওকুফের নির্দেশ ইউজিসির কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি - dainik shiksha পদত্যাগ করেছেন সেই তিন বিতর্কিত বিচারপতি কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান - dainik shiksha ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বিচার হওয়া উচিত: সলিমুল্লাহ খান বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল - dainik shiksha বিচারকের সামনে যে হুমকি দিলেন কামরুল please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026040077209473