শরীরের ওজনের সমপরিমান বৃত্তি : বিকৃত ও উদ্ভট এক মানসিকতা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

‘শুনহ মানুষ ভাই ,

সবার উপরে মানুষ সত্য , তাহার উপরে নাই । ‘

কবির কবিতা শাশ্বত ও চিরন্তন। যুগ যুগান্তরে কত কবি এভাবে কেবলি মানুষের জয়গান রচনা করেছেন। মানুষ ‘ আশরাফুল মাখলুকাত ‘। সৃষ্টির সূচনায় মানুষকে সেজদা করার জন্য ফেরেস্তাদের নির্দেশ করেন স্বয়ং আল্লাহ পাক রাব্বুল আলামীন । ইবলিশ শয়তান ঐশী আদেশ অমান্য করে আদমকে মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য অভিশপ্ত জীবন নিয়ে বেহেশত থেকে বিতাড়িত হয় ।পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনে এর জ্বাজল্য প্রমাণ বিদ্যমান । মানুষের অপমান স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা সেদিন বরদাশত করেননি।

‘ধনের মানুষ মানুষ নয়, মনের মানুষই প্রকৃত মানুষ।’ আবার ‘জ্ঞানহীন মানুষ পশুর সমান’।

শিক্ষার প্রসার ও মানব সভ্যতার উৎকর্ষতার কারণে মানুষের দাম্ভিকতা ও অহমিকা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে আজকাল। কিন্তু , একেবারে নির্মূল হয়নি আজো। মানুষ হয়ে মানুষের অপমান – আজো অজান্তে, অজ্ঞাতে সংগঠিত হয়। গত ১৪ মার্চ দেশের একমাত্র শিক্ষা বিষয় অনলাইন পত্রিকা ‘দৈনিকশিক্ষাডটকমে’ ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায়’ শরীরের ওজনের সমপরিমাণ বৃত্তি’ শীর্ষক সংবাদটি আমাদেরকে’ আইয়্যামে জাহেলিয়ার যুগের’ কথাই মনে করিয়ে দেয়। তখনকার দিনে টাকা পয়সায় মানুষকে কেনা বেচা করা হতো। মানুষের কাছে মানুষের মূল্য ছিল পণ্যের মতো। হাটে বাজারে মানুষ বিক্রি করতো মানুষ। আমরা কী আবার সে অন্ধকারে ফিরে যেতে বসেছি ?

বেসরকারি সংস্থা ডাব্লিউ ডাব্লিউ ফাউন্ডেশণ কেন বা কোন উদ্দেশ্যে এ কাজটি করতে গেলো- তা অনেকের বোধগম্য নহে। তারা মানুষকে পণ্য বানাবার অপচেষ্ঠা করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। টাকা বা অর্থের মানদন্ডে তারা মানুষকে বিচার করতে চেয়েছে- যা বর্তমান যুগে অলীক ও অবাস্তব। তাদের এ অমূলক ধারণা বা আইডিয়াটি তারা কোথায় পেল- সে কেবল তারাই জানে? তারা হয়তো জানে না যে, নিষ্প্রাণ মানুষের দেহ পরিমাপ করা যায়। প্রাণহীন দেহের ওজন নির্ণয় করা যায়। কিন্তু জীবন্ত একজন মানুষের মূল্য কোন মানুষ বেঁধে দিতে কিংবা নির্ণয় করতে পারে না। টাকার অংকে তো নয়-ই ।

মেধাবী শিক্ষার্থীদের মেধার স্বীকৃতি প্রদানের বিষয়টি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কীর্তিমানকে সম্মাননা দেয়া নিঃসন্দেহে সামাজিক তো বটে, নৈতিক দায়িত্ব ও আমাদের সকলের। কিন্তু ঝালকাঠির কিছু বিত্তবানের চিত্তহীন কর্মকাণ্ডটি সচেতন ও বিবেকবান যে কোন মানুষকে পীড়িত করেছে। এভাবে শরীরের ওজন মেপে ওজনের সমপরিমাণ টাকা দিয়ে তারা কেবল মেধার অবমূল্যায়নই করেনি, গোটা মানব জাতিকেই অপমানিত করেছে। এভাবে যদি এতোই খায়েশ হলো, তবে তারা ওজনের সমপরিমান ১০০০ টাকার নোট দিয়ে বৃত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করলো না কেন? কিংবা ওজনের সমপরিমাণ সোনা দিলে ও কারো আপত্তি থাকতো না।তারা সেরা মেধাবীদের পাঁচ লক্ষ, দশ লক্ষ কিংবা কুড়ি লক্ষ টাকা নতুবা এদের সারা জীবনের লেখাপড়ার খরচ চালাবার একটা তহবিল গঠন করে দিতে পারতো। নিশ্চয় তাদের সে রকম প্রাচুর্য ও ধনৈশ্বর্য্য আছে। ১০০০ টাকার কাগজি মুদ্রায় তা নিশ্চয় কয়েক কোটি টাকায় দাঁড়াতো। মাত্র ৩৫০০০ টাকা কিংবা ৫০০০০ টাকা বৃত্তি দেবার জন্য শরীর ওজনের কী প্রয়োজন পড়েছিল? তারা কী-না মাত্র পাঁচ টাকার ধাতব মুদ্রা দিয়ে ওজনের সমপরিমাণ বৃত্তির টাকার হিসেব করেছে। নিঃসন্দেহে এটি উদ্যোক্তাদের বিকৃত ও উদ্ভট মানসিকতাকে ফুটিয়ে তুলে ।

হতে পারে তারা মেধাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে চেয়েছে কিংবা মেধাবীদের অবহেলার পাত্র হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্ঠা করেছে। অথবা এমন ও হতে পারে যে এরা মানুষকে মানুষই মনে করেনি । এ ও হতে পারে যে, এরা ঐশ্বর্যের নীচে মানুষের প্রতিভাকে মাটি চাপা দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মানুষ হয়ে মানুষের অপমান করার অপরাধে তারা ঘৃণিত হয়ে থাকবে বহুদিন।

আমাদের ছোটবেলায় মুরুব্বিরা অনেক সময় কৌতুক করে ধাঁধাঁর ছলে জিজ্ঞেস করতেন-‘ বুদ্ধি বড় না হাতি বড়? ‘বয়স কম থাকায় আমরা না বুঝে অবলীলায় উত্তর দিতাম, ‘হাতি বড়’। আজো বুদ্ধি জিনিসটা চোখে না দেখলেও সেদিনের উত্তরটা যে কতই বেমানান ছিল- তা অক্ষরে অক্ষরে আজ উপলব্ধি করে থাকি ।

মেধা কিংবা প্রতিভা জিনিসটাকে পণ্যের ন্যায় দাঁড়িপাল্লা কিংবা বাটখারা দিয়ে ওজন বা পরিমাপ করার কোন জো বা হেতু নেই। যে ওজন তারা করেছে, তাতে শরীরের হাড্ডি- মাংশের ওজন জেনেছে বটে, কিন্তু মেধার কোন ওজন জানতে পারেনি তারা, নির্ণয় করতে পারেনি মানুষের মূল্য। সেরা মেধাবীদের বৃত্তি প্রদানের জন্য এরকম একটি পদ্ধতি ২০১১ সাল থেকে চলে আসছে- জেনে সচেতন মানুষ মাত্রই হতবাক হবেন। মানুষকে দাড়িপাল্লায় মাপা বা ওজন করার এ বাজে কর্মটি অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া সমীচিন হবে। আজো কবির কবিতার নিম্নোক্ত পংক্তিগুলোর আবেদন ফুরিয়ে যায়নি,

‘গাহি সাম্যের গান,

মানুষের চেয়ে বড় নহে কিছু, নহে কিছু মহীয়ান। ‘

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0033550262451172