শর্তসাপেক্ষে নিজেদের স্কুলে প্রবেশের সুযোগ পেল দোয়ারাবাজারের মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুরা। মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) দ্বিতীয় দিনে স্কুলের প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিতে আসেনি। যারা এসেছিল তাদেরও প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা প্রখর রোদে বসে পরীক্ষা দিতে হয়েছে। পরে স্কুল ঘরের দরজা খুলে দিলে ভেতরে বসে বাকি সময়টুকু পরীক্ষা দেয় তারা। এর আগে সোমবার সন্ধ্যায় চাপের মুখে ও শর্তসাপেক্ষে স্কুলের জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার এবং দোয়ারাবাজার কলেজের পরিত্যক্ত ঘর কিছুদিনের জন্য ব্যবহার করবেন বলে কলেজ অধ্যক্ষের কাছে লিখিত দেন ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। ওই এলাকার চারটি গ্রামের শিশুরা এ বিদ্যালয়ে পড়ে। জেলা প্রশাসক, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, ইউএনওসহ সবাই স্কুলটি রক্ষার পক্ষে, কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। ফলে শিক্ষক ও অভিভাবকরা চিন্তিত আদৌ শিক্ষার্থীরা স্কুলটিতে পড়তে পারবে কি-না।
জমিজমার মালিকানা নিয়ে পাশের দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের সঙ্গে বিরোধ থাকায় সোমবার (২৩ এপ্রিল) স্কুল ঘর থেকে অমানবিকভাবে ১৬২ শিশু শিক্ষার্থীকে বের করে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা প্রখর রোদে খোলা আকাশের নিচে বসে পরীক্ষা দেওয়ায় সাত শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তারা হলো- বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির তৃপ্ত দাস, বর্ষা, জগাই ও মাধাই:দ্বিতীয় শ্রেণির তাহমিনা বেগম ও রুবেল এবং পঞ্চম শ্রেণির মামুন। এ ছাড়া প্রখর রোদে বাইরে পরীক্ষা দেওয়ার পর মঙ্গলবার (২৪ এপ্রিল) ভয়ে প্রায় অর্ধেক শিশু পরীক্ষা দিতে আসেনি।
গতকাল বিদ্যালয়ের চারজন শিক্ষকই জানান, সোমবার (২৩ এপ্রিল) বিকেলে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান রেণু মিয়া এসে তাদের জানান, দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন, মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পক্ষে ১৭ এপ্রিল করা জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার করতে হবে। এ ছাড়া যেখানে স্কুল পরিচালনা হচ্ছে, সেখানে কিছুদিন স্কুল পরিচালনার জন্য একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে, তাহলেই স্কুল ঘর খুলে দেওয়া হবে। শেষে বাধ্য হয়ে বিকেল সাড়ে ৫টায় কলেজের প্রভাষক শের মাহমুদ ভূঁইয়া ও সাইফুর রহমানের সঙ্গে প্রধান শিক্ষক রুবী রানী দাস উপজেলা পরিষদে গিয়ে জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার করেন। সে সময় জানানো হয়েছিল সকাল ৯টায় স্কুল খোলা থাকবে। কিন্তু বেলা ১১টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের প্রখর রোদে মাঠে বসে পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক রুবী রানী দাস এ প্রসঙ্গে বলেন, আমরা স্কুলকে বাঁচানোর জন্য সব চেষ্টাই করছি। বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অধ্যক্ষসহ গণ্যমান্যরা যা বলছেন সবই করছি। সহকারী শিক্ষক সাহেলা বেগম বলেন, রোদে বাইরে বসে পরীক্ষা দিতে হবে- এ ভয়ে মঙ্গলবার শিশুরা স্কুলে আসেনি। যারা অসুস্থ হয়েছে তাদের মুখের দিকে তাকালে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। তারা চিন্তিত, তাদের স্কুলটির এখন কী হবে?
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা নুরুল ইসলাম বলেন, মংলারগাঁও, তেগাঙা, পশ্চিম নৈনগাঁও ও নৈনগাঁও কান্দিপাড়া- এই চার গ্রামে কোনো স্কুল নেই। আট কিলোমিটারের মাঝখানের এই বেসরকারি স্কুলটি প্রায় ১১ বছরের চেষ্টায় কিছু মানুষ প্রতিষ্ঠা করেছেন। এক নিমেষেই কলেজ অধ্যক্ষ স্কুলটি বন্ধ করে দিতে চাচ্ছেন। দলিল দেখে আমরা জানতে পেরেছি এ স্কুলের জমি মংলারগাঁওয়ের সারদা কান্তি দাস ১৯৯৪ সালে মহাপরিচালক, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নামে রেজিস্ট্রি দানপত্র দলিল (নম্বর ৪৬৩৪/৯৪) করে দিয়েছিলেন। দানপত্র করার পর এই জমির মালিক তিনি আর থাকেন না। তিনি পরে আবার ১৯৯৮ সালে এই জমি কীভাবে কলেজ অধ্যক্ষকে দানপত্র রেজিস্ট্রি করে দেন, এটি আমাদের প্রশ্ন।
মংলারগাঁওয়ের সাবেক ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয়ের জমিও এখন কলেজের দখলে, কলেজের নিজস্ব ভূমিও আছে। অর্পিত জমির ১১৫ শতাংশও কলেজের দখলে। এত জমি কলেজের থাকার পরও স্কুলকে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এটি কার স্বার্থে হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়টি তাহলে কি জমি না থাকায় বন্ধ হয়ে যাবে? স্থানীয় সমাজকর্মী মাসুক মিয়া বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেই শিক্ষার্থীরা কলেজে পড়বে। চার গ্রামের একটি বিদ্যালয় এভাবে একগুঁয়েমির জন্য বন্ধ হতে পারে না।
স্থানীয় এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বলেন, দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাও। তার আচরণে একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়।
দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশান্ত কুমার দাস বলেন, মংলারগাঁও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সোমবার বিকেলে এসে জমি বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার করেছেন। কেন করেছেন সেটি বলেননি। ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আমরা যে ঘরে স্কুল চলছিল, সেখানে প্রবেশ করার ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্নিষ্টদের বলে দিয়েছি। ভূমি নিয়ে জটিলতা আদালতে সমাধান হবে বলেও জানিয়েছি। আমরা বলেছি স্কুলটি যাতে চালু থাকে। একই জমি দু'বার কীভাবে দানপত্র রেজিস্ট্রি হলো- এমন প্রশ্নের জবাবে ইউএনও বলেন, এর জবাব রেজিস্রদ্বারকেই দিতে হবে।
দোয়ারাবাজার ডিগ্রি কলেজ অধ্যক্ষ একরামুল হক বলেন, ওখানে কখনও স্কুল ছিল না। কিছুদিন হয় কিছু শিক্ষার্থীকে নিয়ে আমাদের একটি কক্ষ ব্যবহার করছেন চারজন শিক্ষক। কলেজ পরিচালনা কমিটিকে না জানিয়ে তাদের এই ঘরটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বন্দোবস্তকৃত অর্পিত জমি বন্দোবস্তের জন্য তারা আবেদন করায় আমরা তাদের ঘর ছাড়ার জন্য বলেছি। এখন তারা বন্দোবস্তের আবেদন প্রত্যাহার করেছে এবং আমাদের ঘরটি ব্যবহারের আবেদন করেছে। আমরা পরিচালনা কমিটির সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব কী করা যায়। কলেজের অনেক জমি রয়েছে, বিদ্যালয়টিকে মানবিক বিবেচনায় রক্ষা করা যায় কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যে জমি আছে সবই এক সময় এই কলেজের লাগবে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চানন বালা বলেন, সোমবার এই স্কুলের সমস্যা নিয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আমাকে জানান। ১৯৯৪ সালে স্কুলটি চালু হয়। মাঝখানে বন্ধ ছিল। ২০০৭ সাল থেকে চলছে। এখন বিদ্যালয়টি আমাদের না হলেও শিক্ষার্থী আমাদের। ১৬২ জন শিক্ষার্থী মাঠে পরীক্ষা দিচ্ছে জেনে ইউএনওকে বলেছি তারা যাতে পরীক্ষা দিতে পারে। এখন সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, স্কুলের জমি একবার দানপত্র রেজিস্ট্রি করে আবার কীভাবে রেজিস্ট্রি হলো, সেটিও দেখার বিষয়। ইউএনও ও অ্যাসিল্যান্ড সেটি দেখবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের বিভাগীয় উপপরিচালক তাহমিনা খাতুন বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কিছুই জানাননি, এ জন্য আমার পক্ষে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম বলেন, যেহেতু সরকারি জমি স্কুলটি ব্যবহার করছে, তারা বন্দোবস্তের আবেদন করলে জনকল্যাণের জন্য এবং প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সূত্র: সমকাল