শর্তের ‘হাফ পাসে’ না, আন্দোলন চলবে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের টানা বিক্ষোভের মুখে তাদের জন্য গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়ার দাবি মেনে নিয়েছে বাস মালিক সমিতি। কিছু শর্তসাপেক্ষে আজ বুধবার থেকেই এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। তবে রাজধানী ঢাকার বাইরে ‘হাফ ভাড়া’ কার্যকর হবে না। দফায় দফায় বৈঠকের পর গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসে। অবশ্য শুধু ঢাকা মহানগরে শর্তসাপেক্ষে ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএ ভবনে গিয়ে সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের সামনে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

এদিকে বিআরটিসির বাসের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হলেও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাসের জন্য এ সংক্রান্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে না বলে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) পক্ষ থেকে। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পরিবহন সংস্থা বিআরটিসি এর আগে গত শুক্রবার তাদের বাসগুলোতে ‘হাফ ভাড়া’ কার্যকরের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মৌখিক আশ্বাসের পরিবর্তে প্রজ্ঞাপনের দাবি তুলেছিলেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) চেয়ারম্যন তাজুল ইসলাম বলেন, ‘গত ২৮ তারিখ এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন (বিআরটিসির বাসের জন্য) জারি হয়েছে। বুধবার থেকে হাফ ভাড়া কার্যকর হবে।’

তবে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত বাসের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেছেন, ‘বেসরকারি বাসে প্রজ্ঞাপনের বিষয় না। এটা আইনে নাই। বাসমালিকরা সিএসআরের (সামাজিক দায়বদ্ধতা) থেকে করছে। ওরা (বাসমালিক) চিঠি ইস্যু করে দেবে সবাইকে। আমাদেরও দেবে।’

শর্তসাপেক্ষে হাফ ভাড়া : গত বুধবার থেকেই ঢাকা মহানগর এলাকায় বাসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর ঘোষণা দিয়েছেন মালিকরা। তবে বাসে ‘হাফ ভাড়া’ দেওয়া যাবে শুধু সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টার মধ্যে। সরকারি ছুটির দিন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন, কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যান্য ছুটির দিনে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার সুযোগ থাকবে না।

অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়া ছবিযুক্ত আইডি কার্ড দেখাতে হবে। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এসব ঘোষণা দেন।

তিনি বলেন, ‘এ সিদ্ধান্ত শুধু ঢাকা মেট্রো এলাকার জন্য কার্যকর হবে, কোনোভাবেই ঢাকার বাইরের জন্য কার্যকর হবে না। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হলো।’

মালিক সমিতির পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসার পরও রামপুরা, নীলক্ষেত ও ধানমণ্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার সড়কে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ চলতে থাকে। পরে বেলা ৩টার দিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি দল ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলন’-এর ব্যানার নিয়ে বিআরটিএ ভবনের সামনে অবস্থান নেয়।

ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর পরিবহন মালিকদের চাপে সরকার বাসের ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ায়। এরপর থেকেই বাসে আগের মতো অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষার্থীরা। 

গত ২৪ নভেম্বর সড়কে সিটি করপোরেশনের গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর সেই আন্দোলন আরও গতি পায়। পরদিন পথে পথে তাদের বিক্ষোভ-অবরোধে রাজধানী ঢাকা কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

এরপর গত ২৬ নভেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জানান, ১ ডিসেম্বর থেকেই বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ চালু হবে। সেজন্য ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখতে হবে। সকাল ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা বিআরটিসি বাসে চলাচলে এ সুবিধা পাবে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির দিনে এ সুবিধা প্রযোজ্য হবে না বলে সেদিন জানান মন্ত্রী।

বেসরকারি বাসেও শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়ার নিয়ম চালু করতে গত ২৫ ও ২৭ নভেম্বর পরিবহন মালিকদের সঙ্গে দুই দফা বৈঠকে বসে বিআরটিএ। কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই সেসব বৈঠক শেষ হয়। ২৭ নভেম্বরের বৈঠকে উল্টো বাসমালিকদের জন্য ভর্তুকি দাবি করা হয়। মালিক সমিতির নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সেদিন দাবি করেন, ঢাকায় নগর পরিবহনের যে বাসগুলো চলে, তার মালিকদের ‘৮০ শতাংশই গরিব’। এ কারণে বাসমালিকদের ক্ষতিপূরণ বা ভর্তুকির বিষয়টি নির্ধারণ করেই হাফ ভাড়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া কোন তহবিল থেকে এ ভর্তুকি আসবে সেটিও নির্ধারণ করতে হবে।

এরই মধ্যে প্রতিদিনই রাস্তায় নেমে নিরাপদ সড়ক ও হাফ ভাড়া কার্যকরসহ ৯ দফা দাবিতে বিক্ষোভ চালিয়ে যেতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তারা ঘোষণা দেন, দাবি পূরণ না হলে গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে বিআরটিএ কার্যালয় ঘেরাও করার। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই গত সোমবার রাতে পূর্ব রামপুরার ডিআইটি সড়কে বাসের চাপায় প্রাণ যায় মো. মাঈনউদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থীর, যে এবারই রামপুরার একরামুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি দিয়েছিল। এ ঘটনায় তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষোভে ফেটে পড়ে স্থানীয়রা। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী গ্রিন অনাবিল পরিবহনের বাসটিসহ অন্তত ১২টি বাসে তারা আগুন দেয়। পরে গতকাল সকালে রামপুরা, মোহাম্মদপুরসহ কয়েকটি জায়গায় শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে। এর মধ্যেই বেলা পৌনে ১২টার দিকে রমনার ইউনিক হাইটসে সংবাদ সম্মেলনে আসেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা।

রামপুরায় বাসচাপায় শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান তারা। তদন্তসাপেক্ষে শিক্ষার্থীকে বাসচাপার ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির দাবিও করেন তারা।

এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি ও আন্দোলনের ব্যাপারে গত কয়েক দিনে আমরা দফায় দফায় সভা করেছি। ঢাকার ১২০টি পরিবহন কোম্পানির এমডি, চেয়ারম্যান ও পাঁচটি পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ছাত্রদের যে দাবি, সে দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তা কার্যকর করার জন্য পহেলা ডিসেম্বর থেকে হাফ ভাড়া কার্যকরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, ছাত্ররা যেন হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য।’

শুধু ঢাকার জন্য কেন এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেই প্রশ্ন তুলে সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক জানতে চান, অন্য শহরেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের জন্য মালিকরা ‘অপেক্ষা’ করছেন কি না। উত্তরে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে শুধু ঢাকা পরিবহন মালিক সমিতি। ছাত্ররা আন্দোলন করুক, তা আমরা চাই না। ছাত্রদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তারা যেন এখন থেকে পড়ালেখায় মনোযোগ দেয়। রাস্তায় এ ধরনের আন্দোলন না করে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে ফেরত যায়।’

তিন দিন আগেও বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠকে পরিবহন মালিকরা শিক্ষার্থীদের দাবি মানতে নারাজ ছিলেন, উল্টো ভর্তুকির দাবি তুলেছিলেন। সেই অবস্থান থেকে তারা সরে এসেছেন কি না তা জানতে চান একজন সাংবাদিক। এর জবাবে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘ঢাকা শহরের বাসমালিকরা গরিব মালিক, ৮০ শতাংশই গরিব মালিক। কেউ বিশ্বাস করুক আর না করুক, এটাই বাস্তব। অনেক মালিক আছেন যার একটি গাড়ি। সেটা থেকে তাদের পরিবারের খরচ চালাতে হয়ে, ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালাতে হয়। ব্যাংক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। ৪০ শতাংশ আছেন যারা চালক থেকে মালিক হয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়টি বিবেচনা করবে বলে আমরা আশা করি।’

শর্তসাপেক্ষে হাফ ভাড়া প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভের ডাক শিক্ষার্থীদের : শুধু ঢাকা মহানগরে শর্তসাপেক্ষে ‘হাফ ভাড়া’ নেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন ৯ দফা দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ঢাকার বনানীতে বিআরটিএ ভবনে গিয়ে সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে নিজেদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরার পর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের সামনে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।

আন্দোলনকারীদের প্রতিনিধি স্টেট কলেজের শিক্ষার্থী এনজামুল হক রামিম বলেন, ‘৯ দফা দাবিতে বুধবার (আজ) সারা দেশে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হবে।’

ছাত্রদের ৯ দফা আন্দোলনের বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘ছাত্ররা বুঝে প্রজ্ঞাপন কী? তাদের দাবি আদায় হয়ে গেছে, এটা মানার বিষয়। ছাত্ররা হাফ ভাড়া চেয়েছিল, সেটা তো হয়ে গেল।’

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074489116668701