শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধ কত দূর?

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বায়ান্ন থেকে একাত্তর। একুশ ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশ মার্চ আর ষোল ডিসেম্বর। বাঙালি জাতীয়তাবাদ উন্মেষের গৌরবময় সময়কাল। সোনালী অর্জনের একক মাইল ফলক। একুশের উপর ভর করে ছাব্বিশ মার্চ আর ষোল ডিসেম্বরের অভ্যুদয়। বীরত্ব গাঁথা ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়। শহীদ মিনার থেকে স্মৃতিসৌধ। দীর্ঘ এক বন্ধুর যাত্রাপথ। বাঙালির আবেগ উচ্ছাসের বাতিঘর। আশা ভরসার সুতিকাগার। এ দুটি তীর্থস্থানে দাঁড়িয়ে মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমিকে পাগল হয়ে ভালোবাসার দৃপ্ত শপথে উন্মত্ত বাঙালি মানস। জীবনকে তুচ্ছ করে মায়ের মর্যাদা রক্ষার শপথে মুষ্টিবদ্ধ। আবেগ তাড়িত হয়ে মাতৃভূমিকে অদম্য ভালোবাসা জানানোর অনুভূতি প্রকাশে উদ্যত। আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে উদার এক খোলা মাঠ। হৃদয়ে মা ও মাতৃভূমির প্রতি স্বল্প সময়ে ভালোবাসা জেগে উঠে উন্মত্ত পদ্মার বুকে এক উর্বর চরের মতো।

কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আত্মপ্রতিষ্ঠালব্ধ জাতির নাম বাঙালি। নানা সময়ে অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছে তারা। তবু হাল ছাড়েনি। বার বার শোষণ, পীড়ন আর বঞ্চনার শিকার হয়েছে। কখনো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকেনি। বিদেশি শক্তির কাছে মাথা নত করেনি। প্রতিবেশীর অত্যাচার নির্যাতন নীরবে হজম করেনি। দীর্ঘ সংগ্রাম আর আত্মত্যাগের পথ পরিক্রমায় স্বাধিকার ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে। ’৫২ আর ’৭১। দূর্গম যাত্রার দু'টো আলোকিত যাত্রী ছাউনি। শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধ। ভালোবাসার অর্ঘ্য দিয়ে নির্মিত ত্যাগের দুই মাইলফলক। হাজার কোটি বছর বাঙালির অস্তিত্ব ধরে রাখার অদম্য দুই সেনানিবাস। সুরক্ষিত দূর্গ। জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার অতন্ত্র প্রহরী। শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধে দাঁড়িয়ে মাথা নত হয়ে আসে প্রতিটি বাঙালির। শহীদদের প্রতি এক অন্য রকম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করে কৃতার্থ হয় মানুষ।

আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। দিনটি এখন সারা বিশ্বের হলেও কেবল বাঙালি জাতিসত্বাকে অন্যভাবে আলোড়িত করার বিশেষ এক জাদুমন্ত্রে উজ্জীবিত হওয়ার দিন। এটি আজ কেবল বাঙালির শোকাবহ কোনো দিবস নয়। বিশ্বের আপামর মানুষের কাছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় সমুজ্জ্বল একটি দিন। গৌরব আর মর্যাদায় মহিমান্বিত একটি তারিখ। অমর একুশ আজ চির অমরত্বের মর্যাদায় ভাস্বর একটি দিবসের পরিচয়। দিনটি কেবল বিলাপের নয়। এখন ভিন্ন রকমের এক আনন্দ ও গৌরবময় দিন। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখের রক্তস্নাত ঝলমলে এক উজ্জ্বল প্রহর। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার অনন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এমন তাৎপর্যমণ্ডিত দিন বিশ্বে কোন জাতির আছে? না, অন্য কারো নেই। ঐতিহাসিক এ দিনটি কেবল ভাষার মর্যাদা এনে দেয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে।

নিছক সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়নি। বাঙালির চির স্বপ্নের স্বাধীনতার বীজটি বপন করার জন্য মহান ভাষা আন্দোলন অপরিহার্য ছিল। এক রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল এই ভাষা আন্দোলন। এটি কেবল ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংঘটিত হয়নি। বাঙালি জাতিকে মকসুদে মঞ্জিলে পৌঁছে দেবার গুরু দায়িত্বটি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গিয়েছে। যে প্রত্যয় নিয়ে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, ’৭১-র ১৬ ডিসেম্বর তার সফল সমাপ্তি। এর মাঝে খুঁজে মেলে অন্য এক আত্মতৃপ্তি। অন্য এক স্বাদে তুষ্ট হয় অতৃপ্ত হৃদয়। এর আবেদন অনিমেষ। এর মাহাত্ম্য অসাধারণ। নিত্যদিন নতুনের মাঝে আরেক নতুন অনুভুতি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে আজ এ লেখায় সকল ভাষা সৈনিকের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসা নিবেদন করি।

কেবল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা দিয়ে তাদের ঋণ শোধ হবে না। আলাদা করে ভাষা ও দেশকে ভালোবাসতে শিখতে হবে। অনেকে ভাষার সংগ্রামকে নিছক এক সংস্কৃতির লড়াই মনে করে থাকে। ভাষা আন্দোলন একান্ত কোনো সাংস্কৃতিক আন্দোলন নয়। এরকম মনে করা ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সৈনিকদের অবমাননার সামিল। মূলত, ভাষার সংগ্রামটি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা পর্ব। এর পথ ধরে স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের উত্তরণ। লাল সবুজের পতাকা অর্জন। এক সাগর রক্ত বিসর্জন দিয়ে কেনা একটি শব্দ। এর নাম স্বাধীনতা।

এর নিরীখে যদি বিচার করি, তাহলে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রাম আজ কতটুকু সফল হতে পেরেছে? সে প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে দেখতে হবে। ভাষা আন্দোলনের প্রায় সাত দশক অতিক্রম করে এসে এরকম একটি প্রশ্ন নিঃসন্দেহে বেমানান। সত্যি দুঃখজনক। আজ পর্যন্ত সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করতে না পারার ব্যর্থতা ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় অর্জনকে ম্লান করে রেখেছে। কথায় কথায় ইংলিশ-বাংলিশ মিশিয়ে যে রকম কথা বলি, তাতে ভাষার মর্যাদা অবশিষ্ট থাকে না। আমাদের সন্তানদের ভিনদেশি ভাষা শেখার বিষয়ে যে রকম আগ্রহ দেখাই, বাংলা শেখার বিষয়ে তার সিঁকি আনা দেখালে আমরা বহুদূর এগিয়ে যেতে পারতাম। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে মামলার রায় আজও বিদেশি ভাষায় দেয়া হয়ে থাকে। সেখানে মাতৃভাষা বাংলার চর্চা না থাকাটা সত্যি পীড়াদায়ক। এই সেদিনমাত্র এক আলোচিত মামলার রায় বাংলায় দেয়া হয়েছে। তাতে ভাষা শহীদদের আত্মা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছে। ভাষার মর্যাদা একটু হলেও প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে।

এবারের একুশকে সামনে রেখে এটি করা কতটুকু আন্তরিকতার পরিচয় বহন করে, সেটি আগামীর সময় বলে দেবে। আমাদের অভ্যাস এরকম যে, কোনো কিছু সামনে এলে তা নিয়ে আমরা আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলি। সময় গত হলে খোঁজ-খবর নেই। এই যেমন-ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা ও ভাষা সৈনিকদের জন্য আমাদের দরদ উথলে পড়ে। এরপর ভাষা কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে আর কারো মাথা ব্যথা থাকে না। মার্চ কিংবা ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে যেটুকু মেতে উঠি, অন্য কোনো মাসে এর অর্ধেকও বলাবলি করি না। এ রকম আত্মভোলা হলে চলে কী করে?

আমরা সন্তানদের বাংলার চেয়ে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করাতে অধিক আগ্রহ দেখিয়ে থাকি। ভিনদেশি কালচারে গড়ে তুলতে পছন্দ করি। এটি মাতৃভাষা ও ভাষা আন্দোলনের অন্তর্নিহিত তাৎপর্যকে সরাসরি আঘাত করে। এ বোধটুকু আমাদের মাঝে আজ পর্যন্ত জন্ম নেয়নি। কোনদিন জন্ম নেবে কে জানে? যেদিন জন্ম নেবে, সেদিন মাতৃভাষার প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসার জন্ম হবে। মানুষ দেখানো প্রেম দিয়ে লাভ নেই। প্রেম হৃদয় থেকে উৎসারিত না হলে মানুষ দেখানো ভালোবাসার দাম নেই। এর চেয়ে বড় প্রতারণা হতে পারে না। এটি আত্মপ্রবঞ্চনা।

আজকাল কথায় কথায় দু’ চার কথা ইংরেজি বলতে পারলে আমরা তার প্রশংসা করি। বাংলায় পণ্ডিত ব্যক্তিরও তেমন কদর নেই। এই আমাদের অবস্থা। এর উত্তরণ কোনদিন হবে, কে জানে? পরশ্রীকাতরতা আমাদের খুব বেশি তাড়িত করে। ভুলে গেলে চলবে না যে, আমরা ভাষা সৈনিকদের উত্তরসূরী। ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। বীরের জাতির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। অন্যকে অনুসরণ নয়। মানুষ আমাদের অনুকরণ করবে। অন্যে আমাদের অনুকরণ করার মতো যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান রয়েছে। আমাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিজেদের লালন করতে হবে। এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মতো প্রেক্ষাপট অন্য অনেকের নেই।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করা আজ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলা বানান নিয়ে ইদানিং নানা জটিলতা লক্ষ করা যায়। ই-কার ও ঈ-কার, দন্ত্য-ন ও মূর্ধন্য-ণ, দন্ত্য-স ও মূর্ধন্য-ষ ব্যবহারে অনেকে ব্যাকরণ ও বাংলা একাডেমি প্রণীত বিধি বিধান এড়িয়ে যায়। যে যার মতো করে লিখে। দোকানের সাইনবোর্ড এবং গাড়ি ঘোড়ায় যে যার মতো করে বানান লিখে রাখে। এসব কি দেখার কেউ নেই? এসব বিষয়ে নজরদারি না করলে বাংলা ভাষা দিনে দিনে হীন হয়ে যাবে। অযত্নে অবহেলায় রোগে শোকে জর্জরিত হবে। এ রকম করে পৃথিবী থেকে কত ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। কার কাছে এর হিসেব আছে? এ আমাদের কাম্য নয়। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন নিশ্চিত করে এর উৎকর্ষ সাধন করতে না পারলে ভাষা শহীদদের অভিশাপ সারাজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে।

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তা রেবেকার অনিয়মই যেনো নিয়ম! সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে - dainik shiksha সনদ জালিয়াতিতে শনাক্ত আরো কয়েকজন নজরদারিতে শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল - dainik shiksha শিক্ষা প্রশাসনে বড় রদবদল আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি - dainik shiksha আকাশে মেঘ দেখলেই স্কুল ছুটি প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসে শিক্ষক চাই না please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0072360038757324