নিজ বিদ্যালয়ে না থাকায় ইট আর মাটি দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নওগাঁর চক এনায়েত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কয়েক শিক্ষার্থী। শহরের সার্কিট হাউসের পেছনে কোমাইগাড়ি (মণ্ডলপাড়া) এলাকায় রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হয় মাটির এই শহীদ মিনার। শিশু শিক্ষার্থীরা কেউ বাড়ির গাছের ফুল দিয়ে, কেউ বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা চেয়ে ফুল কিনে সেই শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানিয়েছে। স্কুলটির দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী মুন্নি আকতার জানায়, তার স্কুলে কোনো শহীদ মিনার নেই। তাই তারা কয়েকজন মিলে মাটি দিয়েই তৈরি করেছে শহীদ মিনার। বৃহস্পতিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আকতারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার। অনেক স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় শহীদ মিনার না থাকায় মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা শহীদদের ত্যাগ এবং অবদান সম্পর্কে জানতে পারছে না তরুণ প্রজন্ম। জাতীয় শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস), প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরসহ বিভিন্ন সূত্র বলছে- দেশে এক লাখের বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার। এমন পরিস্থিতিতেই গতকাল উদযাপিত হয়েছে মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভিত রচিত হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। অথচ এই প্রাথমিক বিদ্যালয়েই উপেক্ষিত শহীদ মিনার। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) তথ্যমতে- দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ৬৫ হাজার ৬২০টি। এর মধ্যে শহীদ মিনার রয়েছে মাত্র ১৮ হাজার ২১৯টিতে। সে হিসাবে শুধু সরকারি প্রাথমিকের ৪৭ হাজার ৪০১টি বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। এ ছাড়া প্রাথমিক পর্যায়েই রয়েছে ৪ হাজার ৭৫৪ নন-রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৪২টি কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রিচিং আউট অব স্কুল চিলড্রেন (রস্ক) ৩ হাজার ১৯৯টি এবং শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট প্রাথমিক বিদ্যালয় ২০৩টি। এসব বিদ্যালয়েরও অন্তত ৮০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী গতকাল বলেন, দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকতে হবে। ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস শিক্ষার্থীরা কি শুধু পুঁথিগত বিদ্যার মাধ্যমে শিখবে? এটি তাদের অন্তরে ধারণ ও লালন করার বিষয়। সরকারের একটি নির্দেশনা রয়েছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করা হয়নি। আমি মনে করি সময় এসেছে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার।
ব্যানবেইসের তথ্যমতে, দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল-কলেজ রয়েছে ৩৫ হাজার ২২৫টি। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে শহীদ মিনার নেই ১৭ হাজার ৯৭টিতে। দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলে ডিগ্রি, অনার্স ও মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ১ হাজার ৯৪১টি। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সহস্রাধিক কলেজে শহীদ মিনার নেই। শহীদ মিনার সবচেয়ে উপেক্ষিত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। ব্যানবেইসের বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্যমতে দেশে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে ১৩৭টি। যদিও বাস্তবে এর সংখ্যা প্রায় ৫০০-এর কাছাকাছি। এসব প্রতিষ্ঠানের ৯০ শতাংশের বেশি প্রতিষ্ঠানেই নেই শহীদ মিনার।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপন করতে সারা দেশের স্কুল-কলেজ অধ্যক্ষদের কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। নির্দেশনা পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে শহীদ মিনার স্থাপন করেছে। আশা করছি, বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোও শিগগিরই শহীদ মিনার করবে।
নেহাল আহমেদ আরও বলেন, শহীদ মিনার শুধু শহীদ দিবস পালনের জন্য নয়। আমরা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা অর্জন করেছি। মাতৃভাষা দিবস এখন আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। শিক্ষার্থীরা এই ইতিহাস না জানলে শুধু পুঁথিগত পড়াশোনা করে লাভ হবে না। বাংলা ভাষা আমাদের আলাদা পরিচয় দিয়েছে। শহীদ মিনার আর মাতৃভাষার ইতিহাস না জানলে নতুন প্রজন্ম অসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে।
মহাপরিচালক বলেন, একটি শহীদ মিনার করতে বেশি টাকা লাগে না। তবুও যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেরা শহীদ মিনার নির্মাণ করতে পারছে না তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।