শাস্তিই শেষ কথা নয়

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রোববার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলার যে ঘটনা ঘটেছে তা যে কাউকে উদ্বিগ্ন না করে পারে না। এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম, দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকতা করছি, এর সুবাদে বিভিন্ন সময় এ ধরনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। '৯০-এর দশকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটত। হল দখল, চাঁদাবাজি এমনকি হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। ওইসব ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই সবার ধারণা, এ ধরনের অপরাধের কোনো বিচার হয় না। তবে বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে অভিযুক্তদের বহিস্কার, গ্রেপ্তার ও বিচার প্রক্রিয়া প্রত্যক্ষ করে মানুষের মনে বদ্ধমূল বিচারহীনতার সেই চিন্তা অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম, এ ধরনের ঘটনা আর প্রত্যক্ষ করতে হবে না। কিন্তু ছাত্রলীগ তার লাগাম টানার পরিবর্তে সহিংসতা বজায় রেখেছে। বুয়েটের ঘটনায় একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হলেও আরও ২০ ছাত্রের জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। তারা সবাই মেধাবী ছিল। এই মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতির ছত্রছায়ায় এসে একসময় দানবে পরিণত হয়েছে। এখন শুধু তাদের শাস্তি নিশ্চিত হলেই যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে তা নয়; বরং এই মেধাবীরা ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় দানবে পরিণত হচ্ছে, তা চিহ্নিত করে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ করা দরকার। তা না হলে এ ধরনের সহিংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে। মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, ডাকসু ভবনে ভিপির কক্ষে হামলা হয়েছে। দু'জন শিক্ষার্থীকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালের আইসিইউতে তারা সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এটা খুঁজে বের করতে হবে ক্ষমতাসীনদের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ বা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ কেন এ হামলা চালাল? তাদের খুঁটির জোর কোথায়? আমরা দেখেছি, যারা ক্ষমতার সঙ্গে সংশ্নিষ্ট থাকে তারাই এ ধরনের ঘটনা ঘটায়। হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতারা জড়িত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ নামের সংগঠনের নেতারা নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করার কথা নয়। কিন্তু তারা করেছে। এটা নিছকই গুণ্ডামি। বলা হচ্ছে, ডাকসুতে বহিরাগতরা এসেছিল- অভিযোগ সত্য হলে প্রশাসনকে জানাতে পারত। কিন্তু তা না করে জমিদারি মনোভাব পোষণ ও মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। ভিপি নুর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে দেখতে গেছেন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অনেকেই আবার ভিপি নুরকে অভিনেতা বলে সামাজিক মাধ্যমে ট্রল করছেন। একজন অভিনেতা হোক আর যাই হোক, তাকে তো মারধর করা ঠিক নয়। এর মাধ্যমে তার নাগরিক অধিকার খর্ব করা হয়েছে।

আমরা উগ্রতা বা সন্ত্রাসের জায়গায় বারবার ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ সংগঠনকে দেখেছি। তারা কেন এটা করে? আমরা চাই রাজনীতি থাক। কিন্তু সেটা হতে হবে ছাত্রবান্ধব। লুটেরা বা খুনের রাজনীতি নয়। ছাত্রদের ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার মতো আশকারা বা দাপট দেখতে চাই না। একটি ক্যাম্পাসে বিভিন্ন মতের মানুষ থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ক্ষমতার দাপটে কেউ কাউকে আঘাত করবে আর প্রশাসন সে ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেবে না, এটা অস্বাভাবিক। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়; অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে নিত্যই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকেও চাঁদা দিতে হয়েছে। প্রশাসন তাদের তোয়াজ করে টিকে থাকছে। শিক্ষক হিসেবে এ অরাজকতার সমাপ্তি চাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এক বছর পর শতবছর পূর্ণ হবে। এতদিন পরে এসে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে সহিংসতা বা খুনের রাজনীতি চলতে দেওয়া যায় না। এ ধরনের সহিংসতা থামাতেই হবে। এর জন্য প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা অন্যায় করবে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা প্রশাসনের দায়িত্ব। অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া কোনোভাবেই কল্যাণকর হবে না। দ্বিতীয়ত, ক্ষমতাসীন দলকে স্বচ্ছ হতে হবে। কারণ ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনই মূলত এ ধরনের ঘটনার নেপথ্যে থাকে। তাদেরকে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। শুধু মুখে মুখে স্বচ্ছতার কথা বলে দায় না এড়িয়ে প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে। তৃতীয়ত, ক্যাম্পাসগুলোর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপরও বর্তায়। তাদেরকে যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত, মুক্তচিন্তার পরিসর বৃদ্ধি ও অবাধ সাংস্কৃতিক চর্চা নিশ্চিত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগী হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে, জ্ঞানচর্চা না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যু ঘটে।

সরকারের উচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শুদ্ধি অভিযান চালানো। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে এটা মুখে বললেই চলবে না, বাস্তবায়ন করতে হবে। দলের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে যারা মাস্তানি-চাঁদাবাজি করে তাদের রুখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় অস্থিতিশীল হলে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণাকর্ম ব্যাহত হয়। আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা না থাকলে এ ধরনের অরাজকতা আরও পাকাপোক্ত হয়। যথেষ্ট হয়েছে, এখন থামতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়কে রেহাই দিতে হবে।

আজ আমরা এ হামলার যে প্রতিবাদ জানাচ্ছি, কথা বলছি তা শুধু একজন নুরের জন্য নয়। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরকে নিস্কণ্টক দেখতে চাই। এখানে জ্ঞান, মুক্তচিন্তা ও সাংস্কৃতিক চর্চা হবে- এটাই কাম্য, আমরা খুনোখুনি বা উগ্রতা দেখতে চাই না। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, নুরুল হক নুর শুধু একজন ব্যক্তিই নন, তিনি ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি। অথচ তিনিই বারবার মারধরের শিকার হচ্ছেন। যেখানে ভিপি নিরাপদ নন, সেখানে অন্য শিক্ষার্থীরা কতটুকু স্বস্তিতে রয়েছেন, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে দিন পার করছে, কেউ মত প্রকাশের সাহস পাচ্ছে না। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম-গেস্টরুমের অমানবিক নির্যাতনের কথা জানি। সাধারণত দলীয় লেজুড়বৃত্তি, পদ-পদবি, টাকার হিসাব যুক্ত হলে এ ধরনের বিচ্যুতি আসে। '৯০-এর দশকে এ ধরনের অপরাধ করে পার পাওয়া গেলেও এখন সম্ভব নয়। মানুষ মুহূর্তের মধ্যে সব জানতে পারছে। সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায় নির্ণয় করতে পারছে। ছাত্ররাজনীতির এই পরিণতির জন্য মূলত রাজনৈতিক দলগুলোই দায়ী। দলগুলোর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইঙ্গিতেই অস্থিরতা তৈরি হয়। আমরা ডাকসু নির্বাচনেও এ ধরনের অস্থিরতা দেখেছি। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ডাকসু নির্বাচন। স্বয়ং রাষ্ট্রপতিও এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন থেকে সেশনজট নেই, একধরনের স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে। কারা এই অবস্থার ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে, তাদের চিহ্নিত করতে হবে। কারও হাতে কেউ যাতে আহত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রথমত, হামলার কারণ চিহ্নিত করে দ্রুত দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা দরকার। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জবাবদিহি, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল হওয়া দরকার। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যাতে শিক্ষার্থীদের কেউ দানবে পরিণত না হয়।

কাবেরী গায়েন : অধ্যাপক, চেয়ারপারসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0031049251556396