শিক্ষককে অসম্মান করার পরিণতি ভালো হয় না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর আগের মতো নেই, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সর্বশেষ মুন্সীগঞ্জ জেলার বিনোদপুর রাজকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ঘটনাটি এর উদাহরণ হতে পারে।

জানা যায়, ২০ মার্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির কয়েকজন ছাত্র ধর্মকে বিজ্ঞানের সঙ্গে প্যারালাল করে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে কিছু প্রশ্ন করে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের কথোপকথন রেকর্ড করে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেয়। দুদিন পর হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মামলা হলে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। পরে বিষয়টি নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচনা শুরু হলে তিনি ১৯ দিন পর জামিনে ছাড়া পান। ভিডিওতে দেখা যায়, কতিপয় ছাত্র তার বিরুদ্ধে শিষ্টাচারবহির্ভূত ভাষায় স্লোগান দিচ্ছে এবং জুতা প্রদর্শন করছে। বুধবার (২০ এপ্রিল) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, প্রায় কাছাকাছি সময়ে নওগাঁর মহাদেবপুরে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। গত ৭ এপ্রিল দাউল বারাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী স্কুল ড্রেস না পরে অ্যাসেমব্লিতে দাঁড়ালে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আমোদিনি পাল ও শরীরচর্চা শিক্ষক তাদের বেত্রাঘাত করেন। অথচ গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় ছাত্রীরা হিজাব পরে স্কুলে না আসায় শিক্ষকরা তাদের বেত্রাঘাত করেছেন। এতে স্থানীয় উত্তেজিত লোকজন স্কুলের অফিস ঘরে আক্রমণ করে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে।

শিক্ষকরা গুরুজন, তাদের শ্রদ্ধা করতে হয়-এটা এদেশের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। যারা এ ধরনের ঘটনার জন্য শুধু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ধর্মপন্থি রাজনীতিকদের দায়ী করছেন, তারা সম্ভবত সমস্যার গভীরে যেতে চান না। কারণ শুধু হৃদয় মন্ডল, আমোদিনি পাল প্রমুখ ব্যক্তিই নন, দেশের বিভিন্ন স্থানে সমসাময়িক সময়ে আরও কয়েকজন সংখ্যালঘু শিক্ষক ও ব্যক্তিকে একই ধরনের অভিযোগে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

একসময় এ ভূখণ্ডে যে বিপুলসংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিল, তা প্রমাণের জন্য বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই, জনপদের নামগুলোই যথেষ্ট (যেমন: নারায়ণগঞ্জ, মদনগঞ্জ, বিক্রমপুর, বিনোদপুর ইত্যাদি)। ব্রিটিশ আমলে এদেশে হিন্দুদের হাত ধরে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। পুরোনো নামকরা স্কুলগুলোর প্রধান শিক্ষক ছিলেন উচ্চশিক্ষিত হিন্দুরাই। এখনো যে কজন হিন্দু শিক্ষক আছেন, তারাও শিক্ষায় নিবেদিত রয়েছেন। অথচ ধর্ম অবমাননার ভুয়া অভিযোগ তুলে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। ২৫-৩০ বছর আগেও জনসাধারণ সংকীর্ণ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা এমন আক্রান্ত ও বিভক্ত ছিল না। এখানে গত ১৯৭৯ সালে আমাদের এলাকার প্রিয় শিক্ষক অমূল্যচরণ চৌধুরীর হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী সময়ে এলাকাবাসীর সম্মিলিত প্রতিবাদের ঘটনা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। অমূল্যচরণ চৌধুরী নাটোর জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার অন্তর্গত রাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আমৃত্যু প্রধান শিক্ষক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বর্তমানে প্রতিবছর এ স্কুল মাঠেই রাজশাহী বিভাগের সবচেয়ে বড় বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলটির প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৫৬ সাল এবং প্রতিষ্ঠাতা ডা. বীরেন্দ্রলাল সেন রায়।

পাকিস্তান আমলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি) নাটোরে মহকুমা প্রশাসক থাকাকালীন স্কুলটি পরিদর্শনে এসেছিলেন। সেই সুবাদে তার সঙ্গে অমূল্যচরণ চৌধুরী ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ডা. বীরেন্দ্রলাল সেন রায়ের গ্রুপ ছবি রয়েছে (অফিস কক্ষের দেওয়ালে ওই ছবিটিসহ স্যারের আরেকটি সিঙ্গেল ছবি দীর্ঘদিন শোভা পেতে দেখা গেছে। এখন আর সেই ছবিগুলো দেখা যায় না।  

স্যারের মৃত্যুবার্ষিকীও পালিত হয় না। এটাও বর্তমান স্কুল কর্তৃপক্ষের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ কি না-প্রশ্ন করা যেতে পারে)। অমূল্যচরণ চৌধুরী সাধারণ কৃষক পরিবারের সন্তান ছিলেন। মাটির দেওয়াল দেওয়া ঘরে বসবাস ছিল তার। ওই এলাকার জনসাধারণের মধ্যে তখনও শতকরা ২০-২৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। দশম শ্রেণিতে আমার ৪৫ জন সহপাঠীর মধ্যে হিন্দু ছাত্র ছিল ১৫ জন। স্কুলের ১৬ জন শিক্ষকের মধ্যে হিন্দু শিক্ষক ছিলেন পাঁচজন। বর্তমানে গ্রামাঞ্চলে হিন্দু বসতি আগের মতো নেই। তাদের অধিকাংশ দেশত্যাগ করেছেন। অমূল্যচরণ চৌধুরীর পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে গেলেও তার বংশের কয়েকজন জন্ম ভিটার আকর্ষণে এখনো গ্রামাঞ্চলে বসবাস করছেন।

অমূল্যচরণ চৌধুরী ইংরেজি ও ইতিহাস এ দুই বিষয়ে পৃথক পৃথকভাবে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন (সেজন্য এলাকায় তাকে ডাবল এমএ পাশ বলা হতো)। তাছাড়া এলএলবি ডিগ্রিও অর্জন করেছিলেন তিনি। সে সময় তার কাছে যে কোনো সরকারি চাকরি জোগাড় করা কষ্টসাধ্য ছিল না। এমনকি ওকালতি পেশায় যোগ দিয়ে নাটোর শহরে আয়েশি জীবনযাপন করতে পারতেন। সেসব দিকে না গিয়ে এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়ানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা পেশাকেই বেছে নেন। ইংরেজি তার প্রিয় বিষয় হওয়ায় তিনি শুধু নবম ও দশম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তার ইংরেজি উচ্চারণ, শব্দচয়ন, পরিচ্ছন্ন পোশাক-পরিচ্ছদ, চুল আচড়ানোর স্টাইল প্রভৃতি আমাদের খুবই আকর্ষণ করত। লুঙ্গি পরে কোনো ছাত্র ক্লাসে এলে তা তিনি মোটেই বরদাশত করতেন না। রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পড়লে তিনিও মাঝেমধ্যে লুঙ্গি পরে স্কুলে আসতেন। তবে স্কুলের আঙিনায় ঢোকার আগে ব্যাগ থেকে শার্ট-প্যান্ট বের করে তা পরিধান করে তবেই স্কুলের অফিসে প্রবেশ করতেন। একদিন নবম শ্রেণিতে আজিজ নামের একজন ছাত্র লুঙ্গি পরে ক্লাসে এলে তিনি রাগ করে শাসনের ছলে তার পিঠে ডাস্টার দিয়ে দুই-তিনটি আঘাত করেন। রফিকুল নামের একজন পঙ্গু ছেলে ছিল ওই ক্লাসের ফার্স্ট বয় (বাল্যকালে পোলিও রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটত)। সে মেধাবী ছাত্র হলেও মনে মনে কিছুটা সাম্প্রদায়িক ছিল। তার ঈশারায় আজিজ প্রধান শিক্ষককে পেছন দিক থেকে স্যান্ডেল দিয়ে আঘাত করে দৌড়ে ক্লাস থেকে পালিয়ে যায়। বাংলা ক্লাসের মকবুল স্যার (যিনি এলাকায় কবি ও সাহিত্যিক নামে পরিচিত) আমাদের ক্লাসে এসে ক্লাস ফাঁকি দেওয়া ও বেয়াড়া টাইপের আমাদের কয়জনকে আদেশ দেন আজিজ আর রফিকুলকে ধরে আনার জন্য। রফিকুলকে পাওয়া না গেলেও আজিজকে পাওয়া যায় তার বাড়ির খাটের নিচে। আমরা সেখান থেকে তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে এনে অফিস কক্ষে স্যারদের কাছে সোপর্দ করি। তাদের দুজনকে তখনই ফোর্স টিসি দিয়ে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনার ৪-৫ মাস পর অমূল্যচরণ চৌধুরী কতিপয় দুষ্কৃতকারীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন। সেদিন স্যারের স্ত্রী শিশু-সন্তানদের নিয়ে পিত্রালয়ে থাকায় স্যার একাকী বাড়িতে ছিলেন। গভীর রাতে ছাত্রের পরিচয় দিয়ে দুষ্কৃতকারী দরজা খুলতে বললে স্যার সরলবিশ্বাসে দরজা খুলে দেন। দুষ্কৃতকারীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে বুকে-পিঠে আঘাত করে তাকে হত্যা করে। প্রধান শিক্ষকের খুনের ঘটনায় সমগ্র এলাকা উত্তাল হয়ে পড়ে এবং খুনিদের বিচারের দাবিতে মিছিল-মিটিং চলতে থাকে। প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজন (যাদের মধ্যে স্যারের কয়েকজন সাবেক ছাত্রও ছিলেন) স্কুলে এসে খুব দ্রুত খুনিদের গ্রেফতারের প্রতিশ্রুতি দেন। এ ঘটনায় আজিজ আর রফিকুলকেও সন্দেহবশত গ্রেফতার করা হয়। তারা খুনের সঙ্গে কোনোরূপ সংশ্লিষ্ট থাকার কথা অস্বীকার করলেও রফিকুল পুলিশি প্রহারের ভয়ে তার বড় ভাইয়ের কাছে একটি অবৈধ রিভলবার আছে বলে স্বীকারোক্তি দেয়। পুলিশ তার বড় ভাইকে গ্রেফতার করে অবৈধ রিভলবারটি উদ্ধার করে। তার বড় ভাই পুলিশি নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন মাস পর হাসপাতালে মারা যান। এরই মধ্যে পুলিশ হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলে। খুনিদের মুখে জানা গেছে, এলাকার এক প্রভাবশালী পরিবারের সঙ্গে স্কুলের তহবিল তছরুপ ও খাসজমির ভুয়া পত্তন সংক্রান্ত বিষয়ে স্যারের দ্বন্দ্ব ছিল। এক সালিশি বৈঠকে অমূল্যচরণ চৌধুরী ওই প্রভাবশালী পরিবারটির বিরুদ্ধে অর্থদণ্ডের রায় দিলে তারা প্রতিশোধবশত ভাড়াটিয়া খুনিদের দ্বারা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। পরবর্তী সময়ে সাক্ষীর অভাবে আসামিরা বেকসুর খালাস পেলেও প্রকৃতির বিচারে তাদের ঠিকই সাজা হয়েছে। তাদের দুজন গণপিটুনিতে (চরমপন্থি হিসাবে), একজন সড়ক দুর্ঘটনায়, একজন স্যালো মেশিন চালাতে গিয়ে এবং আরেকজন দুরারোগ্য রোগে মারা গেছেন। প্রভাবশালী পরিবারটির কোনো সদস্যই লেখাপড়া কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যে কোনো উন্নতি লাভ করেনি। তাদের অনেকেই এখন অন্যের বাড়িতে কামলা খেটে দিনাতিপাত করছে। তাদের এই মর্মান্তিক পরিণতি প্রসঙ্গে এলাকাবাসীর মন্তব্য-‘খোদার বিচারে কেউই রেহাই পায় না’।

শিক্ষকের সঙ্গে বেয়াদবি করলে এর বিচার কী ভয়ানক হতে পারে, তার প্রমাণ আমরা আজিজ আর রফিকুলের পরবর্তী জীবনে দেখতে পাই। আজিজের লেখাপড়া সে সময়েই ক্ষান্ত হয়ে গেছে। রফিকুল এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজাল্ট করেও উচ্চশিক্ষা লাভে ব্যর্থ হয়। বর্তমানে সে কোথায় আছে, কী করছে, কেউই খোঁজ রাখেন না।

লেখক : মোশাররফ হোসেন মুসা, গণতন্ত্রায়ণ ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0052530765533447