শিক্ষককে চড় ও সমাজের দায়

অলোক আচার্য |

চুয়াডাঙ্গার ভিক্টোরিয়া জুবিলি (ভিজে) সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে এসএসসির নির্বাচনী পরীক্ষা চলাকালে শিক্ষককে চড়থাপ্পড় মারার অভিযোগ উঠেছে। মূলত শিক্ষককে থাপ্পড় মারার সিসিটিভি ফুটেজ ভাইরাল হয়েছে এবং যারা দেখেছেন সকলেই সেই ছাত্রের শাস্তি দাবি করেছেন। প্রশ্ন হলো সেই ছাত্রের যদি কঠোর শাস্তিও হয় তাহলেও কি সমাজ তার নৈতিক অধঃপতন অস্বীকার করতে পারে? আমি সিসিটিভি ফুটেজে যতোটুকু দেখেছি সেখানে শিক্ষক ছাত্রের খাতা নেয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই করেননি। কিন্তু ছাত্র আচমকাই শিক্ষককে প্রহর করে বসে। শিক্ষকের গাল আছে থাপ্পড় দেয়ার জন্য, সমাজেরও কি গাল আছে? এই থাপ্পড় কি সমাজের গালেও লাগেনি? এতো শিক্ষার ভিড়ে চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে নৈতিক শিক্ষার অভাবে আজ সমাজ নিচের দিকে ধাবমান। কেউ দেখছেন, কেউ দেখছেন না। যারা দেখছেন তারাও চুপচাপ বসে আছেন। কারণ, কিছুই করার নেই। এখন শিক্ষককে চড় দেয়া যায়, শিক্ষককে পেটানো যায় আরো নানাভাবে হয়রানি করা যায়! কারণ, তাদেরও রক্তমাংসের শরীর এবং প্রায় শান্ত স্বভাবের মানুষ।

চাইলেও তারা উগ্রভাবে প্রতিবাদ করতে পারেন না। কারণ, তারা শিক্ষক। শিক্ষকতা একটি পেশা। অন্য পেশার মতো এখান থেকেও একজন পেশাজীবীর সংসার নির্বাহ হয়। তবে অন্য পেশার সঙ্গে এর কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। শিক্ষকের দায়িত্ব অন্য পেশার থেকে অনেক বেশি। অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাকে এই পেশায় আসতে হয়। সন্তান মানুষ না হলে যেমন বাবা-মা’র ওপর দায় চাপে, সেই সমপরিমাণ দায় শিক্ষকের ওপরও আসে। তাকে শেখাতে না পারার ব্যর্থতার গ্লানি থাকে। আবার সফলতা আসলে বিপরীত চিত্র থাকে। এটাই শিক্ষকতা। অনেকদিন আগের কথা মনে আছে? ছাত্রের নির্মম আঘাতে উৎপল কুমার নামের একজন শিক্ষকের করুণ মৃত্যু ঘটে। তার মৃত্যুর পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ঘটনাটিকে নৈতিক অধঃপতনসহ আরো নানাভাবে ধিক্কার জানায়। ধিক্কারের মতোই একটি ঘটনা এটি। আমিও ধিক্কার জানাই। কিন্তু এই ঘটনা কেনো ঘটলো বা একজন শিক্ষকের গায়ে আঘাত করার মানসিকতা কি একদিনে তৈরি হয়েছে বা হওয়া সম্ভব? এই মানসিকতা তৈরির পেছনে শুধু ওই অপরাধী ছাত্রকে দায় দিয়ে বসে থেকে কোনো লাভ নেই। সমাজটা পচে যাচ্ছে সে খেয়াল রাখিনি। সমাজে শিক্ষকের যে অবস্থান ছিলো আজ তা নেই। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক ক্রমেই আলগা হয়েছে। যতো সম্পর্ক ঢিলা হয়েছে ততো শ্রদ্ধা, ভক্তি কমেছে। সেই বাদশা আলমগীরের মতো এখন আর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার মতো অবস্থা নেই! তার জন্য কেউ এককভাবে দায়ী নয়। পুরো সমাজ ব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে দায়ী। যখন আমি আমার সন্তানকে কাউকে সম্মান করাতে শেখাতে পারিনি তখন সে তার শিক্ষককেও অসম্মান করবে। একজন শিক্ষকের যে তার সন্তান তুল্য ছাত্রকে শাসন করার অধিকার আছে সেই বোধটাই সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে। আর এখানেই সমস্যা তৈরি হয়েছে। আমি একজন শিক্ষক এবং গত পনেরো বছর ধরেই ছাত্রছাত্রী পড়ানোর কাজটি করেছি। শিক্ষা দিতে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে ভালো হতে পারিনি। হওয়ার চেষ্টাও করিনি। সেটা সম্ভবও নয়। 

শিক্ষককে লাঞ্চিত করার ঘটনা কিন্তু আমাদের দেশে প্রথম নয়। প্রায়ই ঘটছে। সে ছাত্র করুক বা অন্য কেউ। তবে ছাত্রের হাতে লাঞ্চিত হওয়ার ঘটনা আরো বেশি দুঃখজনক, ন্যাক্কারজনক এবং মানসিক কষ্টের। আমি একজন শিক্ষক এবং আমার সঙ্গে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে শিক্ষকতা পেশায় থেকে যেতাম কি না সন্দেহ। এ ধরনের কয়টি ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে? কোনো শিক্ষকের অনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা আর তাকে লাঞ্চিত করা এক কথা নয়। আবার এটা যে কেবল এই সময়েই ঘটছে মানে ছাত্র তার শিক্ষাগুরুর গায়ে হাত তুলছে বা হয়রানি করছে তা নয়। অনেক আগে থেকেই এই নৈতিক অধঃপতনের শুরু হয়েছে। একটু একটু করে ক্ষয়ে গেছে সেই নৈতিকতার স্থান। যার ফলে আজ একজন শিক্ষককে কোনো অপরাধ ছাড়াই ছাত্রের হাতে প্রাণ দিতে হলো। আমরা যদি এখনো ঘুরে না দাঁড়াই তাহলে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক তার ছাত্রছাত্রীকে শাসন করতে যাবেন কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ, শাসন মানেই সেই ছাত্রের বিরাগভাজন হতে হবে। আবার শুধু ছাত্রছাত্রী কেনো অনেক অবিবেচক অভিভাবককেও দেখেছি তুচ্ছ কোনো কারণে তার সন্তানের হয়ে শিক্ষককে অপমান করতে ছাড়েন না।

এক্ষেত্রে সেই ছাত্র আরো বেশি সাহস পান। অবশ্য ছাত্রকে শাসন করা যদি অপরাধের ভেতর পরে তো অন্য কথা! একসময় মানে আমাদের সময় বাবা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়ে শিক্ষকদের বলে আসতেন-আমার সন্তানকে রেখে গেলাম। ওকে পড়ানোর প্রয়োজনে যা শাসনের দরকার হয় করবেন। এখন ছাত্রছাত্রীকে শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করা নিষেধ। কিন্তু একটা সময় ছিলো যখন শিক্ষকরা বেত নিয়েই ক্লাসে যেতেন। পড়া না হওয়ার জন্য, দুষ্টুমির জন্য বেতের মার খেতে হয়েছে। কিন্তু শিক্ষকদের প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিলো না বা এখনো নেই। আমি মনে করেছি এই শাসনের অধিকার কেবল আমার শিক্ষকদেরই ছিলো। আর এখন সামান্য শাসনও ধৈর্যের বাধ ভেঙে দেয়। মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষা ব্যতীত অন্য চাহিদাগুলো পূরণ কঠিন এবং জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে শিক্ষার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। আর এই শিক্ষা প্রদানের কাজটি যে করতে পারেন তিনিই শিক্ষক। সুতরাং তাকে সম্মান করা বা শিক্ষকের মর্যাদা রক্ষার শিক্ষাটাও পারিবারিকভাবে হওয়া দরকার। এটা বলছি যে, আমি পাবলিক পরীক্ষার কক্ষ পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনকালে অনেক অভিভাবককে তার সন্তানকে তাদের ভাষায় ‘একটু সুযোগ’ দেয়ার আবদার শুনেছি। 

গ্রীসের সক্রেটিস, প্লেটোর হাত ধরে শিক্ষকের যে ধারণা বা স্বরুপ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই শিক্ষা দানের প্রক্রিয়া আজও বহমান। শিক্ষকরা আমাদের গুরু। শিক্ষকরা এই সমাজেরই গুরু। প্রাচীনকালে গুরু টোল খুলে গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের পড়াতেন। মাটিতে বসে টুল জাতীয় উঁচু একটি জিনিসে বই রেখে লেখাপড়া চলতো। প্রাচীন গুরুদের সম্মান ছিলো সবার ওপরে। রাজ দরবারেও ছিলো শিক্ষকদের সম্মান। যদিও এই দীর্ঘ যাত্রায় অন্যসব কিছু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষকদের জীবনযাত্রার ধরন এবং কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটেছে কিন্তু যে শিকড়ের সন্ধান শিক্ষক প্রদান করে সেই কাজটি এখনো সেভাবেই চলছে। সেটা মোবাইল বা ল্যাপটপ বা টেলিভিশনে-যেভাবেই হোক না কেনো। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রছাত্রীর যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং সেই সম্পর্ক আজীবন থেকে যায়। একজন ছাত্রকে দিয়ে সব ছাত্র সমাজকে বিবেচনা করা উচিত হবে না। কারণ, আমার বহু ছাত্রছাত্রী আমাকে শ্রদ্ধা করেন। রাস্তায় দেখলে আবেগে চোখ ভিজে আসে। ভাবি, এমন পেশা আর দ্বিতীয়টি নেই। এটা আমার জন্য গর্বের। শিক্ষকতা সত্যিকার অর্থেই একটি গর্বের বিষয়। কিন্তু একজন উৎপল কুমারকে কেনো মরতে হবে সেটা নিয়ে সতর্ক বা সচেতন হওয়া উচিত। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের কোন অংশে ঘুণ ধরছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। দেশের মেধাসম্পদ তৈরি করার মূল কারিগর হলেন শিক্ষক। শিক্ষকের হাত ধরেই একজন শিক্ষার্থী দক্ষতা অর্জন করেন। দেশকে কিছু দেয়ার সুযোগ অর্জন করে। একটি শ্রেণিকক্ষ যেখানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আন্তরিকতায় স্বার্থক শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। সেখানে থাকবে বিশ্বাস, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। আর না হলে একসময় আমাদের আরো খারাপ অবস্থায় পড়তে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074009895324707