আমরা উন্নয়ন চাই। কেননা জাতি হিসেবে আমরা দরিদ্র। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক প্রয়োজনগুলো মেটাতে আমরা অতিশয় দুর্বল। তাই দরিদ্র, দুর্বল ও অনুন্নত নামক নানা অভিধায় আমরা অভিহিত হই। কিন্তু আমরা দরিদ্র ও দুর্বল থাকতে চাই না। আমরা উন্নত, সমৃদ্ধ ও সবল জীবন চাই। তাই দেশে উন্নয়নের ব্যাপারে এত আগ্রহ, আলোচনা ও উদ্যোগ। কারণ আমাদের কাছে উন্নয়ন মানেই দারিদ্র্য বিমোচন। এর ফলে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাবে যে দুর্গতি, তা থেকে রক্ষা মিলবে। কর্মসংস্থান এবং আয়-রোজগার বাড়বে। আমাদের জীবনমানের উন্নতি হবে। আর এই উন্নয়নের নায়ক হল মানুষ। সেই মানুষকে উন্নয়নের কারিগর বা নায়ক করতে হলে তাকে শিক্ষাদান করতে হবে। শিক্ষাই জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করে এবং হয়ে দাঁড়ায় উন্নয়নের চালিকাশক্তি। তাই অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন যথার্থই বলেছেন, উন্নয়ন বলতে বোঝায় মানুষের উন্নয়ন।
আমাদের অতি কাঙ্ক্ষিত এ উন্নয়নকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে শিক্ষিত মানুষের ক্রান্তিকালীন ভূমিকার কারণেই প্রতিটি সরকার শিক্ষার ওপর জোর দিয়ে থাকে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বর্তমান সরকারের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকার যে গুরুত্ব দিচ্ছে, তা মাঠপর্যায়ে কতটা কার্যকর হচ্ছে সেটা এখন বিশেষভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ শিক্ষায় আগ্রহী ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সত্যিকার অর্থে শিক্ষার অগ্রগতি হচ্ছে না। সংখ্যায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও ছাত্র বাড়ছে বটে, তবে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ছে না। গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা না হলে তাকে সত্যিকার শিক্ষা বলা যায় না। এ নিবন্ধে মূলত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার দিকেই আলোকপাত করা হবে। উপরোক্ত দুটো পর্যায়ে, বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার কিছু প্রধান সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলোর সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা করাই আমাদের উদ্দেশ্য।
শিক্ষায় সংকটের কারণ হিসেবে অনেকেই বাজেটে শিক্ষায় স্বল্প বরাদ্দের কথা বলে থাকেন। এটা সত্য, শিক্ষা খাতে দেশে জিডিপির মাত্র ২.৪ শতাংশ ব্যয় করা হয়। অথচ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো এবং উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের মতো স্বল্পোন্নত দেশগুলোর শিক্ষা বাবদ জিডিপির ৪ শতাংশ ব্যয় করা উচিত। তবে যে ২.৪ শতাংশ বাংলাদেশ ব্যয় করে সেটিও যথাযথ কাজে লাগে কিনা তার মূল্যায়ন এখন বেশি দরকার। আজ থেকে ৫০ বছর আগেকার, অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের শিক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ যদি দেখি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা যদি বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে শিক্ষা খাতে উন্নয়নকে অবহেলা না করে বরঞ্চ প্রশংসা করতে হয়। সুতরাং শিক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর দাবিকে যেমন সমর্থন করব, তেমনি এর কার্যকারিতার দিকটি মূল্যায়নের দাবিতেও অটল থাকব। কারণ আগেই বলেছি, গুণগতভাবে শিক্ষার উন্নয়ন হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয় না।
কেন উন্নয়ন হচ্ছে না, এর একটি সাদামাটা উত্তর হচ্ছে, শিক্ষক ঠিকমতো পড়াচ্ছেন না এবং ছাত্র ঠিকমতো পড়ছে না। কথাটি বলার জন্য দুঃখিত। এটাকে একেবারে সাধারণ সত্য বলা যাবে না। তবে কথাটি বহুলাংশে সত্য। বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান সমস্যাগুলোর পেছনে আরও অনেক কারণ আছে। বিদ্যালয়ে পর্যাপ্ত ভৌতিক অবকাঠামোর অভাব, শিক্ষা-সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, সিলেবাসে ত্রুটি, শিক্ষকতা পেশার প্রতি মেধাবীদের আগ্রহ ও আকর্ষণের অভাবসহ বহুবিধ সমস্যা শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাজমান। তবে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হল শিক্ষক। শিক্ষক যথাযথভাবে শিক্ষাদান করলেই ছাত্ররা শিখবে। এটাই সাধারণভাবে সঠিক ও গ্রহণযোগ্য বলে মানুষ মনে করে। অভিযোগ হচ্ছে, শিক্ষক ঠিকমতো পড়ান না। কেন এমনটি ঘটছে? এর বেশকিছু কারণ আছে। একটি কারণ হল- শিক্ষক নিজেই শিক্ষায় দুর্বল। নিজেই যেখানে জানেন না, সেখানে তারা ছাত্রদের শেখাবেন কী? মাধ্যমিক স্তরে এই দুর্বল ও অনুপযুক্ত শিক্ষকদের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রায় প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ দুর্বল। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্বল অঙ্ক, ইংরেজি ও বিজ্ঞানে।
অযোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হল, মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় মনে করে না। এর কারণ শুধু আর্থিক নয়, সামাজিকও বটে। আমাদের সমাজে প্রচলিত মূল্যবোধ হচ্ছে, শিক্ষকতা গরিবের চাকরি। দেশে ক্ষমতাবান ও সম্পদশালী হওয়ার সুযোগসম্পন্ন চাকরিরই মর্যাদা বেশি। শিক্ষকতায় এ দুটোরই অভাব। সেদিন আমার এক স্নেহভাজন ছাত্রের শিক্ষা বিভাগে চাকরি পাওয়ার কথা শুনে তার বন্ধুটির প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমাদের দেশে কৃষক ও শিক্ষকের কোনো দাম নাই।’ এ ধরনের নিকৃষ্ট মূল্যবোধ যে আমাদের দারিদ্র্যের এবং শিক্ষকতা পেশার আকর্ষণহীনতার কারণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
দ্বিতীয় কারণটি হচ্ছে, শিক্ষাদানে সবল ও সক্ষম শিক্ষকরাও শ্রেণীকক্ষে পাঠদানে আন্তরিক ও আগ্রহী থাকেন না। অথচ প্রাইভেট পড়ানোর ব্যাপারে তাদের আগ্রহের অভাব থাকে না। কর্তব্য-কাজে আন্তরিকতাহীনতা ও ফাঁকিবাজি যে দেশে কর্মসংস্কৃতির একটি অন্যতম বেশিষ্ট্য, সেখানে শিক্ষকই বা পিছিয়ে থাকবেন কেন? তাছাড়া মাস গেলে বেতন যেখানে প্রায় নিশ্চিত, সেখানে প্রাইভেট পড়িয়ে আরও কিছু বেশি রোজগার করার আকর্ষণও কম নয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় শ্রেণীকক্ষের স্বাভাবিক পড়াশোনা। মাধ্যমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার দাবিতে শিক্ষকদের সোচ্চার দেখি। আমরা এর বিপক্ষে নই। তবে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ যে ইতিমধ্যে শিক্ষাকে প্রাইভেট কোচিং ও টিউশনের মাধ্যমে বেসরকারীকরণ করে ফেলেছেন, সেটা কী তারা স্বীকার করেন? প্রাইভেট পড়ানোর এই প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শহরাঞ্চলে, যেখানে ধনী মানুষের সংখ্যা বেশি। গ্রামের মানুষের সন্তানদের প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য কম। বিদ্যালয়েও রয়েছে শিক্ষক স্বল্পতা এবং যারা আছেন তাদের বড় অংশই দুর্বল। তাই ঠিকমতো পড়াশোনা হয় না। ফলে সমাজের এই বড় জনগোষ্ঠীটি শিক্ষা ক্ষেত্রে ভীষণ বঞ্চনার শিকার হচ্ছে।
প্রাইভেট টিউশন এবং কোচিং বাণিজ্য একদিকে যেমন আইন করে বন্ধ করতে হবে, তেমনি শিক্ষকরা যাতে নিয়মিত ক্লাস নেন সেটিও নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার্থীরা যাতে নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত থাকে সে ব্যাপারে শিক্ষক ও অভিভাবকদেরও দায়িত্ব আছে। মোটকথা, প্রধান শিক্ষক, বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটি, অভিভাবক এবং জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের প্রধানত শিক্ষকদের কাজকর্মের প্রতি নজর রাখতে হবে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। অন্যদিকে শিক্ষাদান এবং শিক্ষকতার আকর্ষণ বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি-দাওয়া পূরণ করতে হবে। শিক্ষকতার আকর্ষণ বাড়াতে আর্থিক ও সামাজিক প্রণোদনার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। এ ব্যাপারে আমাদের অভিমত হচ্ছে, পাঠদান এবং পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং গুণী শিক্ষকদের পুরস্কৃত করতে হবে। অন্যদিকে মন্দ ফলের জন্য বিদ্যালয় ও শিক্ষকদের জবাবদিহির ব্যবস্থা থাকতে হবে। পুরস্কার না পাওয়াও এক ধরনের লজ্জা। প্রতিটি উপজেলায় পাঠদান ও পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়কে ‘বছরের সেরা বিদ্যালয়’ ঘোষণা করার বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। তাছাড়া গুণী শিক্ষকদের নগদ পুরস্কার, শিক্ষামন্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রশংসাপত্র প্রদানসহ পদোন্নতির ব্যাপারে অগ্রাধিকার প্রদানের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনার দাবি রাখে।
শিক্ষার জগতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পরিবর্তন ও উন্নয়ন হচ্ছে। এ জন্য দরকার শিক্ষকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ। এক খবরে জানা গেল, মাধ্যমিক স্তরে সৃজনশীল প্রশ্ন করতে অধিকাংশ শিক্ষকই অক্ষম। এ অক্ষম শিক্ষকদের সক্ষম করে তুলতে হলে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ বছরের প্রথম দিকে একটি দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় শীর্ষ শিরোনাম ছিল, ‘সৃজনশীল প্রশিক্ষণে গলদ ও অব্যবস্থাপনা : ৪ লাখ ৬৮ হাজার শিক্ষকের ৪ লাখেরও বেশি প্রশিক্ষণ পাননি’। কাজেই শিক্ষার সংকটের জন্য অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্তৃপক্ষের গাফলতিও কম দায়ী নয়। তাছাড়া স্কুল শিক্ষকদের একটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, তাদের কর্মজীবনে উন্নতি করার সুযোগ-সুবিধা খুবই সীমিত। পদোন্নতি অতিশয় দুর্লভ। সম্মানজনক বেতন-ভাতা ছাড়াও পদোন্নতির মতো প্রণোদনাও শিক্ষকদের দিতে হবে। তা না হলে শুধু ‘শিক্ষা একটি মহৎ পেশা’ বলে তাদের যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা যাবে বলে মনে হয় না। তবে সেইসঙ্গে তাদের দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করতে হবে। কেবল বেতন ও পদোন্নতির সুযোগ বৃদ্ধিতেই শিক্ষার মান বাড়বে না, যেমন বাড়ে না বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতির সুযোগ সত্ত্বেও সরকারি আমলাদের সেবার মান।
মো. মইনুল ইসলাম : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়