শিক্ষকতা শুধু পেশা নয়, একটি ব্রত

নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস |

শিক্ষক জাতি গঠনের কারিগর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে হয়, ‘শিক্ষার মধ্যে এমন একটা সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না অগ্নি দেয়।’ ‘শিক্ষক’ এমন একটি শব্দ যে শব্দটি উচ্চারণের সাথে ন্যায়নিষ্ঠা, প্রজ্ঞা, অন্তহীন ত্যাগ, মূল্যবোধ, আদর্শবান, অনুপ্রেরণা দানকারী, শুদ্ধতা, পরার্থপরতার প্রতিমূর্তি ভেসে ওঠে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক দুনিয়ার সেরা সম্পর্কগুলোর একটি। কবি কাদের নেওয়াজ রচিত ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ নামক কবিতাটি কম-বেশি সবারই পড়া। শিক্ষকের মর্যাদা যে কত উঁচুমানের ও সম্মানের হতে পারে তা এই কবিতায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আগের যুগে বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর সময়কার ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক আর বর্তমান সময়ের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে ব্যবধান অনেক! এখন অনেক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের হয়রানি, বিভিন্ন অনিয়ম, ক্লাসে কম পড়িয়ে কোচিং শিক্ষায় আগ্রহী করা, প্রশ্নফাঁস, যৌন নির্যাতনসহ নানা অভিযোগের কথাও শোনা যায়! জাল সনদধারী শিক্ষকরাও এ সমাজে এখন দেখা যাচ্ছে! এটা পুরো শিক্ষক সমাজের জন্য লজ্জাকর। শিক্ষকতা শুধু একটি পেশা নয়, একটি ব্রত। অন্য সব পেশা থেকে এ পেশাটা একটু ভিন্ন। কেননা সঠিক পদক্ষেপ, পরিকল্পনা ও দূরদর্শিতার অভাবের কারণে এ পেশায় কোনো ক্ষতি হলে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় তার নীরব প্রভাব পড়ে।

একজন শিক্ষকই পারেন অর্জিত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে শিক্ষার্থীকে সঠিক দীক্ষায় দীক্ষা দিতে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক হওয়া উচিত মূলত অভিভাবকতুল্য ও বন্ধুসুলভ। ‘এডুকেশন ওয়াচ’- এর এক রির্পোট বলছে, অর্ধেকের বেশি  শিক্ষার্থী এখন আর শিক্ষকদের আদর্শ মনে করে না। এটা খুব খারাপ সংবাদ বটে! ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সুসম্পর্কই সারিয়ে তুলতে পারে শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও অস্বস্তিকর বিষয়গুলোকে। 

মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা বর্তমানে কতটা অসহায় তা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলী চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। শিক্ষককে অপমান, নির্যাতন করার মতো ঘটনা মাঝে মাঝেই খবরের শিরোনাম হচ্ছে। শিক্ষককে অপমান, অপদস্থ, গায়ে হাত তোলার মতো ধৃষ্টতার ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের জন্য লজ্জার। এ সমাজে যত ধরনের পেশা আছে তার মধ্যে তুলনামূলক সম্মানজনক, আদর্শপরায়ণ ও ন্যায়নিষ্ঠ পেশা হলো শিক্ষকতা। প্রশ্ন জাগে, সাভারের আশুলিয়ায় হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে কেন তারই শিক্ষার্থীর হাতে মরতে হবে? নড়াইলের সদর উপজলোর মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশাসকে কেন গলায় জুতার মালা পরতে হবে? মুন্সিগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম নিয়ে আলোচনাকে কেন্দ্র করে ভুল বোঝাবুঝির জেরে শিক্ষককে কেন জেলে যেতে হবে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বেগম আসমা সিদ্দীকাকে কেন ক্লাসে হেনস্তা হতে হবে? কেন প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে দপ্তরির হাতে মার খেতে হবে? শিক্ষক সমাজকে একের পর এক অপমান জাতির জন্য অশনিসংকেত। দু’একজন অপরাধীকে শাস্তি দিলেও যে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে এমনটি নয়, সামগ্রিকভাবে সামাজিক পরিবর্তন দরকার। সুনাগরিক হওয়ার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তবে সবাই যে সঠিক শিক্ষা গ্রহণ করছে তা কিন্তু নয়। শিক্ষার্থীরা জ্ঞান অর্জনের জন্য লেখাপড়া করছে নাকি শুধু পাসের জন্য তথা সার্টিফিকেট অর্জনের জন্য শিখছে সেটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। অন্য দেশের তুলনায় বেতন কম পেয়েও একজন শিক্ষক শুধু সম্মানটুকু পেয়ে শিক্ষকতা পেশা বেছে নিয়েছে। সেই সম্মানটুকু নিয়ে যদি টানাটানি করা হয় তাহলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ হারাবে মেধাবীরা। কেন জানি মনে হয়, পাঠ্যবইয়ের পড়ার সাথে বাস্তব জীবনের মিল কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে! সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয় চলছে! শুধু বস্তুগত উন্নয়ন নয়, মন-মানসিকতায় উন্নতি না হলে সে জাতির ভিত্তি দৃঢ় হয় না। মিথ্যাকে মিথ্যা আর সত্যকে সত্য বলতে হবে। এখন শিক্ষার্থীরা যন্ত্রের সাথে সময় কাটাচ্ছে বেশি। মোবাইলটাই যেন বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম! পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে! একটা সময় ছিল, শিক্ষককে মানা হতো সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। ক্লাসের বাইরেও শিক্ষককে দেখলে শিক্ষার্থীর মাথা শ্রদ্ধায় নত হয়ে যেত। কোথায় গেল সে সম্মান? 

শিক্ষকের সাথে খারাপ ব্যবহার করা, অপমান করা, হেয় করার মতো অপরাধ করছে একশ্রেণির শিক্ষার্থী। শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরূপ আচরণের কারণে শিক্ষার্থী বহিষ্কারের মতো ঘটনা এখন অহরহ ঘটছে। কেন জানি মনে হচ্ছে শিক্ষার্থীরা এখন একটু হলেও অতি ব্যস্ত, অসহিষ্ণু ও ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছে! বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অনুশাসনের দিকটা কিছুটা হলেও কমে গেছে! শিক্ষার্থীদের কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। সমাজটা একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন ভাবা হতো শিক্ষক পিতার মতো। আর এখন বহু শিক্ষার্থীর কাছে পিতার পরের আসনটিও শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ নেই। সম্মান-জ্ঞান-গরিমায় শিক্ষক ছিল সবার ওপরে। শিক্ষকের প্রতি ভয় ছিল, যে ভয়টা ছিল মূলত শ্রদ্ধার। আমেরিকার ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহম লিংকন ছেলের স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে যে চিঠি লিখেছিলেন বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সবাইকে সেটির অনুশীলন করা অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। শিক্ষকের উদ্দেশ্যে চিঠির শেষ পর্যায়ে লেখা ছিল- ‘আমার পুত্রের প্রতি সদয় আচরণ করবেন কিন্তু সোহাগ করবেন না। কেননা আগুনে পুড়েই ইস্পাত খাঁটি হয়। আমার সন্তানের যেন অধৈর্য হওয়ার সাহস না থাকে, থাকে যেন তার সাহসী হওয়ার ধৈর্য...।’ এই চিঠির গুরুত্ব যদি সবাই অনুধাবন করতো তাহলে সমাজটা অচিরেই বদলে যেত। 

শিক্ষকের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে ‘বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ’। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে সংগঠনটি শিক্ষকদের অধিকার ও মানসম্মত শিক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সভা, সেমিনার ও শিক্ষকবন্ধনসহ বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ইতোমধ্যে সংগঠনটি শিক্ষক সমাজের প্রিয় সংগঠন হিসেবে সারা বাংলাদেশে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ন্যায় বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের ষষ্ঠ গ্রেড প্রদান, সহ প্রধানদের সপ্তম গ্রেড প্রদান এবং পূর্ণাঙ্গ উৎসব বোনাস প্রদানসহ সংগঠনের পাঁচ দফা যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি। মানসম্মত শিক্ষা পেতে হলে মানসম্মত শিক্ষক তথা দেশ সেরা শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আনতে হবে। মানসম্মত শিক্ষা বিস্তারে শিক্ষকদের স্বতন্ত্র বেতন স্কেল কার্যকর করা জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষকতা পেশার মর্যাদা ও যৌক্তিক বেতনকাঠামো কার্যকর করা হলে শিক্ষার মানও বৃদ্ধি পাবে। এখনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৯০ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সোনার বাংলা গড়তে মাধ্যমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রান্তিক এলাকায় সরকারি সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ‘টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট’(এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এবং ২০৪১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উন্নত দেশ গঠনে মানসম্মত শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ গঠনের বিকল্প নেই। শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন কারিকুলামের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে দেশ। আসন্ন চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় আইসিটি জ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষার্থী সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নতুন কারিকুলাম দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে বলে আশা রাখি।

লেখক : নৃপেন্দ্র চন্দ্র দাস, সভাপতি, বাংলাদেশ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান পরিষদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha স্কুল-মাদরাসা বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ হাইকোর্টের ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ - dainik shiksha ঢাকাসহ ১৩ জেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাল বন্ধ প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি নীতিমালা প্রণয়নের নির্দেশ হাইকোর্টের প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত - dainik shiksha টেম্পু চাপায় কলেজছাত্রী নিহত কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030138492584229