শিক্ষকদের অপমানের বিষয়ে যা বললেন সমন্বয়ক আবু বাকের

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বলেছেন, ‘আমি জানতাম যে আমাকে পদত্যাগ করতে হবে। এটাও জানতাম যে শিক্ষার্থীরা আমার অফিস ঘেরাও করবে এবং তারা আমাকে খোঁজাখুঁজি করছে। ফলে আমি পদত্যাগপত্র সাইন করে অফিসে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু ওরা এতে সন্তুষ্ট হয়নি। তারা চাচ্ছিল আমি যেন তাদের সামনে গিয়ে পদত্যাগ করি।

বিবিসি বাংলাকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি।  নিরাপত্তার কারণে এবং ‘আবারো হয়রানির ভয়ে’ তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। 

ওই শিক্ষক বলেন, ছাত্রদের হাতে ‘অপমানিত হওয়া’ ঠেকাতে তিনি বিভাগে যাওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাকে অফিসে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল।

তিনি বলেন, আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারা ভিডিও করবে এবং সেখানে গেলে যে কোনো একটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত আমি যেতে রাজি হইনি।

নাম-পরিচয় নপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক বলেন, তিনি আওয়ামী লীগ পন্থি নীল দলের সদস্য এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেননি এসব অভিযোগেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। আমি আমার পদত্যাগ মেনে নিয়েছি। তারা আমার অফিস পর্যন্ত গিয়েছে এতে সমস্যা নাই। কিন্তু আমার বাসায় কেন আসবে? আমার পরিবার কেন টার্গেট হবে?

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি, প্রো-ভিসিসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন।

এরমধ্যেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খবর আসতে থাকে যে, কোনো কোনো শিক্ষক হেনস্থার শিকার হচ্ছেন।

শিক্ষকদের ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করা, অপমান-অপদস্থ করা এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেবার অভিযোগও আছে।

ভয়ে আছেন অনেক শিক্ষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চন্দ্রনাথ পোদ্দার। গত ২১ আগস্ট নিজ বিভাগে কাজ শেষে জানতে পারেন নিচে শিক্ষার্থীরা তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

পরে বিভাগে এসে শিক্ষার্থীরা নানা রকম প্রশ্ন করতে থাকেন পোদ্দারকে।

ছাত্র আন্দোলনে তিনি কেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রাখেননি? কেন তিনি নীল দলের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন?এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তাকে। পরে অন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে তাকে জানানো হয় যে তার ক্লাস বয়কট করা হবে।

পোদ্দার বলেন, আমি শুনেছি যে তারা বলেছে, তারা আমার ক্লাস করবে না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও আমাকে স্থায়ীভাবে অবসর নিতে হবে এমন কথাও আমি শুনেছি।

পোদ্দার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক। বিভাগ সূত্রে জানা যাচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনে পোদ্দার অংশ নেননি, এই অভিযোগে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি ছেড়ে দিতে চাপ দেয় শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষার্থীদের হই-হুল্লোড় এবং নানামুখী প্রশ্নে বিপর্যস্ত এই শিক্ষক এখন আর বিভাগে যাচ্ছেন না।

পোদ্দার বিবিসিকে জানান, এই ঘটনার পর তার পরিবারের মধ্যেও ভয় ঢুকে গেছে।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ফাটল?

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, মূলত: আওয়ামী পন্থি শিক্ষক এবং যারা সরাসরি আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেননি, অনেক ক্ষেত্রে তারাই হেনস্থার মুখে পড়েছেন।

শিক্ষকদের নামে ব্যানার বানিয়ে, তালিকা করে, ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়ে যেমন টার্গেট করা হয়েছে, তেমনি অনেককে বাসায় গিয়েও হুমকি দেয়া কিংবা খোঁজ করা হয়েছে।

সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অবস্থা তাতে করে ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ধ্বংস হওয়ার’ মুখোমুখি বলেই মত রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীনের।

তিনি বলেন শিক্ষকদের কেউ কেউ এখন ভয়ে, আতঙ্কের মধ্যে আছেন।

তিনি বলেন, বিভিন্ন বিভাগে লিস্ট তৈরি হয়েছে। অনেক শিক্ষক এখন ক্যাম্পাসে বাসায় থাকছেন না। বিশেষ করে যখন থেকে ছাত্ররা মব তৈরি করে বাসায় বাসায় গিয়ে শিক্ষকদের খুঁজতে শুরু করল। তখন শিক্ষকরা অনিরাপদ বোধ করতে শুরু করল। তারা এখন ভাবছে আজকে অমুক শিক্ষকের বাড়িতে গিয়েছে, কালকে হয়তো আমার বাসায় আসবে। রাস্তায় হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হবে।  সবাই একটা ভয়ের মধ্যে আছে যে কোন কথায় কী রিঅ্যাকশন হবে। স্টুডেন্টরা আবার তেড়ে আসবে না তো?

জোবাইদা নাসরীন মনে করছেন, শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ হওয়ার ঘটনায় বিভিন্ন পক্ষ জড়িয়ে পড়ছে। শুধুমাত্র যে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থন দেওয়া না দেওয়াকে কেন্দ্র করে এসব হচ্ছে তা নয়। এখানে নানা স্বার্থে নানা গ্রুপ এর সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করছে। এখানে শিক্ষক রাজনীতিরও ভূমিকা আছে। কিন্তু এতে করে যা হচ্ছে সেটা হলো ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের মধ্যে একটা বিশাল ফাটল তৈরি হয়েছে।

তার মতে, ভয়-দ্বিধা কাটিয়ে শিক্ষকরা কীভাবে ক্লাসে ফিরবেন সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার শিক্ষার্থীরাও কীভাবে তাদের গ্রহণ করবেন সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু এমন অবস্থা কেন তৈরি হলো? এর পেছনে শিক্ষকদেরও দায় দেখছেন জোবাইদা নাসরীন।

তিনি বলেন, অনেকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন হলে সেটা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেননি। তবে শিক্ষার্থীরা যেটা করতে পারতো যে, কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলে অপেক্ষা করতে পারত। প্রশাসনিক নিয়োগগুলো হয়ে গেলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি তুলে ধরতে পারত। 

বাংলাদেশে বর্তমানে বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই নতুন ভিসি নিয়োগ না পাওয়ায় সেগুলোর প্রশাসনিক কার্যক্রমে এক ধরণের স্থবিরতা আছে।

প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী শিক্ষকরা কার কাছে যাবেন, কীভাবে নিরাপদ থাকবেন সেটাও নিশ্চিত নয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের কোন কোন অংশের ভূমিকা নিয়েও আছে প্রশ্ন।

যদিও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মুজমদার বলছেন, তাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা আছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।

তিনি বলেন, আমরা কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কোথাও কোনো ঘেরাও করি নাই এসব বিষয়ে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সবসময়ই বলেছি যে, শিক্ষার্থীরা যেন এধরণের কোনও কাজের সঙ্গে জড়িত না হয়। তবে কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার অধিকার আছে -আমরা এটাও মনে করি। কিন্তু হেনস্থা করার মতো ঘটনা এসব কাম্য নয়। 

তিনি দাবি করেন, শুরুর দিকে যেসব ঘটনা ঘটছিলো এখন সেগুলো কমেছে। এমনকি যারা এসব করছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কাউকে হেনন্থা না করার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে এর পরও এমন ঘটনা থেমে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ।

এমনকি ভিসি ও অন্যান্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যকারিতাও তৈরি করতে পারেনি সরকার।

যদিও এর মধ্যেই মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন ভাইস-চ্যান্সেলর।

মনে করা হচ্ছে, এভাবে পর্যায়ক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে।

কিন্তু এর মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে যে ‘ভীতি এবং আস্থাহীনতা’ তৈরি হয়েছে সেটা সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha অ্যাডহক কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নতুন নির্দেশনা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ যেনো ধ্বং*সস্তূপ জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল - dainik shiksha জোরপূর্বক পদত্যাগে করানো সেই শিক্ষকের জানাজায় মানুষের ঢল শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় - dainik shiksha শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটি সারানোর এখনই সময় কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0032699108123779