শিক্ষকদের উন্নত জীবনমান চাই

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

আজ বিশ্বকাপ ফাইনাল। ফুটবলের দুই পরাশক্তি ল্যাটিন আমেরিকার আর্জেন্টিনা ও ইউরোপের ফ্রান্স মুখোমুখি হবে। গত প্রায় একমাস ধরে বিশ্বকাপ ফুটবল জ্বরে গোটা পৃথিবী কাঁপছে। আমাদের বাংলাদেশে এই উত্তাপ অন্য দেশের চেয়ে বেশি। 

এদিকে ব্রিটেনে চলতি সপ্তাহে ভয়াবহ ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করেছে। তাপমাত্রা মাইনাস চার-পাঁচ ডিগ্রি চলছে। কখনো সাত-আটেও নেমে যায়। গত দু'দিন ধরে ব্যাপক তুষারপাত হচ্ছে। জনজীবন বিপর্যস্ত হওয়ার উপক্রম। ঘর-দুয়ার, দোকানপাট, গাড়ি-ঘোড়া-সব জায়গায় হিটার চালিয়ে স্বাভাবিক উষ্ণতা বজায় রাখার প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। জ্যাকেটের ওপর জ্যাকেট আর ভারি কাপড়ের প্যান্ট-শার্ট পরে মাথায় গরম ক্যাপ দিয়ে বাইরে বেরুতে হয়। তা না হলে ঠাণ্ডায় পুরো শরীর বরফ হয়ে যাবে! স্বাভাবিক জুতা-মোজায় কুলোয় না। মাঝে মাঝে সূর্যের দেখা মেলে বটে। কিন্তু, এর আলো গায়ে লাগার সুযোগ একেবারে কম। আবহাওয়া অফিস চলতি সপ্তাহে তাপমাত্রা মাইনাস পনেরো ডিগ্রিতে নামার আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্কতা জারি করেছে।

এর আগে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, বাহরাইন ও সৌদি আরবের মতো দেশ ভ্রমণ করে উষ্ণ আবহাওয়া অনুভব করার সুযোগ হয়েছে। এসির বাতাস ছাড়া তাদের জীবন অচল। এখানে ব্রিটেনে এসে শীতল আবহাওয়ার সংস্পর্শে ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। 

একেক দেশে একেক রকম জীবনযাত্রা। কোথাও গরম। কোথাও ঠাণ্ডা। কোথাও নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া। জলবায়ু ও আবহাওয়ার দিক থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভুমির মতো চমৎকার দেশ আর কোথাও নেই। কবির ভাষায় বলতে হয়, 'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভুমি'। 

আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশ প্রকৃতির এক আদুরে কন্যা। এর আলো, বাতাস, উদ্ভিদ, নদ-নদী, অরণ্য, আকাশ, দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ-সবই অনন্য, অসাধারণ। তবে নীতি, নৈতিকতা, সততা, দেশপ্রেম, মানবিকতা, মনুষত্ব ও মূল্যবোধের অভাবে আমরা অনেকের চেয়ে পিছিয়ে আছি। সময়োপযোগী ও বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠার কারণে স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশত বছর পেরিয়ে আজও আমরা অনেকের পেছনে পড়ে রয়েছি। এবার আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫১তম বিজয় দিবস উদযাপন করেছি। করোনার অতিমারীর মধ্যে  স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তি পার করেছি। স্বাধীনতার অর্ধ-শতাব্দী পেরিয়ে এসেও আমাদের প্রত্যাশিত সাফল্য নেই। বিশেষ করে শিক্ষায় আমাদের উল্লেখযোগ্য ফল হাতে গোণা। প্রাথমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণের চার যুগের মাথায় এসেও মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণে কার্যকর উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি। এটি আমাদের চরম ব্যর্থতা। কেবল ঘন ঘন সিলেবাস, কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক ও পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তনে সুফল বয়ে আনতে পারে না। এই কয়েক বছর ছাড়া এর আগে দেশে ঘন ঘন সরকার বদল হয়েছে। একেক সরকার একেক শিক্ষানীতি অনুসরণ করে থাকে। নিজেদের মতো করে সিলেবাস ও কারিকুলাম তৈরি করে। মনগড়া পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করে। যখন যে সিলেবাস ও কারিকুলাম আসে, তখন সেই মতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বটে। প্রশিক্ষণের নামে টাকা মেরে খাওয়ার হরিলুট চলে। প্র্যাকটিস করে করে শিক্ষক পারফেক্ট হতে না হতে আরেকটি নতুন সিস্টেম চলে আসে। এভাবে এক সিস্টেম থেকে আরেক সিস্টেমে যেতে জাতীয় আয় থেকে কোটি কোটি টাকা অপচয় হয়। শিক্ষা প্রশাসনের কতিপয় লোকের ভাগ্য খোলে। তাদের ড্রাইভার-পিয়নরাও পর্যন্ত রাতারাতি টাকার কুমির বনে যান। কেবল শিক্ষকদের দুর্গতি ও দুঃসময়ের অবসান হয় না। 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়'-এমন একটি অবস্থার মধ্যে তাঁদের নিত্যদিন বসবাস করতে হয়। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নত করার চিন্তা কিংবা উদ্যোগ কোনটিই নেই। না আছে সরকারের, না আছে রাষ্ট্রের। 

শিক্ষকরাও মানুষ। তাঁদের একটি জৈবিক চাহিদা আছে। ছেলেময়ে ও পরিবার-পরিজন আছে। সেটি অনেকে উপলব্ধি করতে চান না। যখন বলা হয়, শিক্ষকদের শতভাগ মূল বেতন সরকার দেয়, তখন এক শ্রেণির মানুষ মনে করে শিক্ষকদের আর কোনো চাহিদা বাকি নেই। শতভাগ মূল বেতনের বাইরের বিষয়গুলো সাধারণ লোকজনকে কেউ বুঝিয়েও বলেন না। শিক্ষক নেতৃবৃন্দ কিংবা তাঁদের সমিতিগুলো সিকি বোনাসের কথা, এক হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া ও পাঁচশ টাকা চিকিৎসা খরচের কথা দেশের মানুষকে আজ পর্যন্ত ভালো করে জানান দিতে পারেননি। এগুলো ছাড়া 'শতভাগ বেতন' একটি প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। একটা সময় এতো শিক্ষক সমিতি ছিলো না। ঘরে ঘরে শিক্ষক নেতাও ছিলেন না। সে সময় তাঁরা কার্যকর আন্দোলন-সংগ্রাম করে  সরকার থেকে কিছু কিছু দাবি আদায় করে আনতে পেরেছেন। অথচ আজ এত বছর থেকে বর্তমান সমিতি ও শিক্ষক নেতারা ষোল আনা উৎসব ভাতা কিংবা বিধিমতো বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা ভাতার মতো ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো আদায় করতে পারেননি। এসব বিষয়ে কোনো জনমত গঠন করতে পারেননি। দাবি-দাওয়া এক হলেও নিজেদের মধ্যে কোনো ঐক্যও গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকদের এতো সমিতি আর নেতা দিয়ে কী হবে? একজন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ কিংবা কামরুজ্জামান স্যারের মত জাতীয় শিক্ষক নেতার অভাবে শিক্ষক সমাজের দুর্ভোগ ও দুর্গতির অবসান হচ্ছে না। 
  
আসছে নতুন বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। এই শিক্ষাক্রমটি যাঁরা বাস্তবায়ন করবেন, সেই শিক্ষকদের প্রতি কারো সেরকম সুদৃষ্টি নেই বললে চলে। কয়েক বছর ধরে আমরা শিক্ষকদের চেয়ে শিক্ষার অবকাঠামোগত উন্নয়নে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। অবকাঠামোর অবশ্যই দরকার আছে। কিন্তু যেখানে একটি বিল্ডিংয়ের প্রয়োজন সেখানে দু'টি হচ্ছে। যেখানে একতলা হলে চলে, সেখানে চারতলা বিল্ডিং দেয়া হচ্ছে। অবকাঠামো খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার ওপরে দুর্নীতি হয়। এর ভাগ উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর পর্যন্ত সবাই পেয়ে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত কাজ যারা দেখভাল করে থাকেন, আগে তাদের নাম ফ্যাসিলিটিজ ডিপার্টমেন্ট ছিলো। এখন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর হয়েছে। এদের বেশিরভাগ অফিস দুর্নীতির আখড়া। এসব অফিসে ঠিকাদারদের দাপট বেশি। বেশির ভাগ ঠিকাদার সরকারি দলের লোকজন। ইঞ্জিনিয়ার অফিসের লোকদেরও এদের সমীহ করে চলতে হয়। নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রধান প্রকৌশলীর সাথে এদের দহরম-মহরম বেশি। 
অনেক জায়গায় এদের টাকা খাইয়ে স্কুল-কলেজে দালান-বিল্ডিং আনা লাগে। এমন করে করে অনেক নতুন প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজ দু'তিনটে চার-পাঁচতলা বিল্ডিং পেয়ে বসে। এসব করতে যায় না বলে অনেক ভালো ভালো পুরানো স্কুল-কলেজ উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত থাকে। এসব দৌরাত্ম্য বন্ধ না হলে শিক্ষার মানের উন্নতি কঠিন। যে যাই বলুন না কেনো, শিক্ষকদের আধুনিক ও উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করা না গেলে শিক্ষায় পুরোপুরি সুদিন আসতে দেরী হবে। তাই, শিক্ষায় সর্বাগ্রে এটিই প্রয়োজন।

লেখক :  অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী, আবাসিক সম্পাদক (লন্ডন), দৈনিক শিক্ষাডটকম 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই - dainik shiksha একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু ৩০ জুলাই অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ - dainik shiksha অবসর কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার ফের তাগিদ সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা - dainik shiksha সুধা রানী হাদিসের শিক্ষক পদে : এনটিআরসিএর ব্যাখ্যা শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে - dainik shiksha শরীফ-শরীফার গল্প বাদ যাচ্ছে পাঠ্যবই থেকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক - dainik shiksha শূন্যপদের ভুল চাহিদায় শাস্তি পাবেন কর্মকর্তা ও প্রধান শিক্ষক এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ - dainik shiksha এক রুমে ৩৫ ছাত্রী অসুস্থ, পাঠদান বন্ধ যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে - dainik shiksha যৌ*ন হয়রানির অভিযোগে প্রধান শিক্ষক কারাগারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055339336395264