শিক্ষকদের কাছে মুল্যায়ন সঠিক নয়, নিরাপদ নয়!

মাছুম বিল্লাহ |

যে সব অভিভাবক নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের পথে অন্তরায়ের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনায় সরব, তারা বলছেন শিক্ষকদের হাতে মূল্যায়নের নম্বর থাকলে নতুন শিক্ষাক্রমে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। শিক্ষকদের পাশাপাশি অংশীজনের মূল্যায়ন পক্ষপাতিত্ব বাড়াবে। পূর্ববর্তী কারিকুলামে বিষয়টি সীমাবদ্ধ ছিল তিনটি বা চারটি বিষয়ে। এখন প্রায় প্রতিটি বিষয়ের মূল্যায়ন শিক্ষকদের হাতে। তবে, এর একটি পজেটিভ দিকও আছে। শিক্ষকদের হাতে নম্বর, গ্রেডিং বা পারফরম্যান্স প্রতীক থাকলে শিক্ষার্থীরা এক ধরনের চাপে থাকবে। শিক্ষক যা বলবেন তা শোনার জন্য কিছু বাধ্যবাধকতা থাকবে। অনেক শিক্ষক বেতের কথা বলেন, বেত কোনো সমাধান নয়। আবার এও সত্য, বাধ্যবাধকতার বিষয়টি যদি ব্যক্তি পর্যায়ে থাকে তাহলে সেখানে দুর্নীতির গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা যদি এ ধরনের শিক্ষকদের হাতে ধরা থাকেন তাহলে তার ফল খুব ভাল হচেছ না বলা যায়। প্রাতিষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতা শাসন হলেও শিক্ষার্থীদের এক ধরনের নিয়মানুবর্তিতা বা ডিসিপ্লিন শেখায়। শিশু বয়সে সামান্য বাধ্যবাধকতার মধ্যে দিয়ে ডিসিপ্লিনড কিছু করলে, লাইফ চালাতে সেটি অভ্যাসে পরিণত হয় এবং নিজের ও সামাজিক জীবনে এর প্রভাব অনেকটাই পজেটিভ।

উন্নত বিশ্বের অনেক দেশে শিক্ষার্থীরা পাবলিক পরীক্ষা না দিলেও শিক্ষকরা কিছু বলতে পারেন না, তারা পুরোপুরি স্বাধীন। দেখা যাচেছ, একদল শিক্ষার্থী পাবলিক পরীক্ষা দিচেছ আর কিছু শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের পাশে ঘোড়াঘুড়ি করছে, হাঁটাহাঁটি করছে। শিক্ষক তাদের কিছু বলতে পারছেন না। পরে তাদের আবার সুযোগ দেওয়া হয়। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যেভাবেই দেখা হোক না কেন বিষয়টি অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল, তারপরেও শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার জন্য তারা এরূপ করে থাকেন। ইদানিং অবশ্য ওসব দেশও চিন্তা করছে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের স্বাধীনতা দেয়া কতটা অর্থবহ এবং যৌক্তিক। সেই প্রশ্ন তারা তুলেছেন এবং তা আলোচনার টেবিলে চলে এসেছে। শিক্ষার্থীদের স্বাধীনতার বিষয়টি আমি অবশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুটা  দেখেছি। যেমন প্রথমবর্ষ থেকে দ্বিতীয়, দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় বর্ষে প্রমোশনের সময় যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, ইচেছ করলে কেউ কেউ সেই পরীক্ষা বাদ দিতে পারেন। পরে তাদের জন্য আলাদা একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় যা সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা নামে পরিচিত। যারা রেগুলার পরীক্ষা বাদ দিয়ে সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি দেয়া হয় না। আমাদের ইংরেজি বিভাগের অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থী সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দিত। আমরা কয়েকজন ছিলাম কোনো বছরেই সাপ্লিমেন্টারি পরীক্ষা দেইনি, রেগুলোর পরীক্ষা দিয়েছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক বৃত্তি পেয়েছি। 

বরিশালের সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় আমাদের সিনিয়র ভাইদের দেখতাম দুই-তিন মাস করে বিজ্ঞানের শিক্ষকদের কাছে পড়ছেন। আমরা তখন প্রথম বর্ষে। কারন হিসেবে জানলাম, শিক্ষকগণ ব্যক্তিগতভাবে সব শিক্ষার্থীকে চেনেন না, তাই তাদের সঙ্গে পরিচিত হতে প্রাইভেট পড়তে হয়। তো পরিচিত হতে হবে কেন? পরিচিত না হলে প্র্যাকটিক্যালে ২৫ নম্বরের মধ্যে ৫-৬ নম্বর দিয়ে রাখেন অর্থাৎ ফেল নম্বর। অথচ একটি নম্বরের মূল্য তখন অনেক। আর স্যারদের কাছে পড়লে প্র্যাকটিক্যালে ২৪-২৫ পাওয়া যায়। তিনটি বিষয়ে যদি ৭২ নম্বর কিংবা ৭৫ নম্বর এভাবে পাওয়া যায় তাহলে তো প্রথম বিভাগ পাওয়া অনেক সহজ হয়। তাদের কাছে শিখে আমাদের সঙ্গের অনেকেই পদার্থ, রসায়ন, বায়োলজি শিক্ষকদের কাছে পড়া শুরু করে দিল। আমি পড়িনি। দেখা গেল প্র্যাকটিক্যালে আমাকে প্রথম ৭ দেওয়া হলো। বিষয়টি জেনে শিক্ষকরা আলোচনা করে পরে সেটিকে ১৭ করে দিয়েছেন, ২৪ কিংবা ২৫ দেননি। অথচ আমাদের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস হতো প্রতিদিন। আমাদের যেসব বন্ধুরা বরিশাল কলেজ ও হাতেম আলী কলেজ পড়তেন ( দুটোই তখন বেসরকারি কলেজ) তারা প্র্যাকটিক্যালে ৭৪-৭৫নম্বর করে পেলেন। পরীক্ষার আগে তাদের  জিজ্ঞেস করতাম তাদের প্রাক্টিক্যালের কি অবস্থা? তারা উত্তর দিতেন প্র্যাকটিক্যাল তাদের করতে হয় না বা করার সুযোগও নেই। এত শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিভাবে প্র্যাকটিক্যাল করবে। তোমরা তো বি এম কলেজে আছো তাই প্রতিদিন প্রাকটিক্যাল করতে পার কারণ তোমরা শিক্ষার্থী মাত্র ১২৫ জন। আমাদের তো কয়েক হাজার। তাদের অনেকেই প্র্যাকটিক্যাল ল্যাবরেটরিতে কখনও ঢোকেনওনি। এই ট্রাডিশন কিন্তু স্কুল ও কলেজ সর্বত্রই বিদ্যমান। আমার এক নিকটাত্মীয় বি এম কলেজে পড়তেন, খুবই মেধাবী,  বোর্ডে স্ট্যান্ড করা শিক্ষার্থী, রসায়নে প্র্যাকটিক্যালে তাকে ফেল করিয়েছেন তার শিক্ষক। দুটো মিলে যেহেতু পাস ছিল তাই বেঁচে গেছেন। উচচ মাধ্যমিকের পরেই তিনি তৎকালীন রাশিয়ান সরকারের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে চলে যান। বর্তমানে অষ্ট্রেলিয়াতে বিখ্যাত প্রকৌশলী। কিন্তু তার সারা জীবন মনে থাকবে যে, বি এম কলেজে রসায়নের প্র্যাকটিক্যালে তিনি ফেল করেছিলেন উচচ মাধ্যমিক পরীক্ষায়।

শিক্ষক হিসেবে যখন প্রথম ক্যান্টনমেন্ট কলেজে যোগদান করলাম তখন আর আমি বিজ্ঞানের শিক্ষক নই, ইংরেজির শিক্ষক। কারণ উচ্চ মাধ্যমিকের পরে ভর্তি হলাম ইংরেজিতে। ক্যান্টনমেন্ট কলেজে সহকর্মীদের মধ্যে প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে খুব একটা সমস্যা দেখিনি। তারপর যখন ক্যাডেট কলেজে চাকরি হলো সেখানেতো এ ধরনের প্রাইভেট পড়ার সিস্টেমই নেই। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত প্র্যাকটিক্যাল করে, মেধাবী, পুর্ণ নম্বরই পেয়ে যেত। যখন রাজউক উত্তরা মডেল কলেজে যোগদান করলাম, সেখানে দেখলাম প্রাইভেটের খেলা। প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। রাজউকে অধ্যক্ষ প্রথম থেকেই সেনা অফিসার। আমি যোগদান করার বছর তিনেকের মধ্যে আমার সিলেট ক্যাডেট কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ কর্ণেল সোহরাব স্যার এলেন ( পরবর্তীকালে তিনিও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদে পদোন্নতি  পেয়েছিলেন)। তিনি এসে একটি নিয়ম করলেন যে, কোন শিক্ষার্থীকে  প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করা যাবে না। শিক্ষার্থীরা গোপন ব্যালটের মাধ্যমে উপাধ্যক্ষ-একাডেমিককে জানাবে কে কার কাছে পড়তে চায়। ইংরেজি পড়ানোর ক্ষেত্রে উপাধ্যক্ষ আমাকে দেখালেন যে, ৯৬ শতাংশ শিক্ষার্থী আমার কাছে পড়ার জন্য ভোট দিয়েছে আর আমার বিভাগীয় প্রধান যিনি প্রচুর প্রাইভেট পড়াতেন তাকে শতকরা ৩ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দিয়েছে। বাকীদের এক শতাংশ। এতে স্বভাবতই বিভাগীয় প্রধান ক্ষেপে যাবেন, তার ফলও আমি বিভিন্নভাবে ভোগ করেছি। কিন্তু প্রাইভেট ততটা পড়াইনি। যদিও শিক্ষার্থীরা বলতো কেন পড়াবেন না স্যার? উত্তরে বলতাম আমি যেহেতু দূরে থাকি (ঝামেলা এড়ানোর জন্য ইচেছ করেই দূরে থাকতাম আর সীমিত আকারে প্রাইভেট পড়াতাম)। অনেক শিক্ষার্থী বলতো স্যার উত্তরায় থাকেন, কোনো কোনো শিক্ষার্থী বলতো স্যার আমাদের বাসা খালি আছে আপনি এখানে ভাড়া থাকতে পারেন এবং এখানে আমাদের পড়াতে পারেন। আমাদের কিন্তু প্র্যাকটিক্যালের কোনো ব্যাপার ছিল না। বিজ্ঞানের শিক্ষকদের কাছে প্র্যাকটিক্যালের জন্য তো বটেই, এক ধরনের বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট পড়তো। দুএকটি বিষয়ে প্রাইভেট পড়া সে রকম দরকার হয় না, তারপরেও শিক্ষার্থীদের পড়তে হতো। 

কলেজ কেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে নম্বর থাকায় ( প্রথম বিভাগ দেয়া এবং তাতে পজেশন দেয়া তাদের হাতেই) তারাও শিক্ষার্থীদের এক ধরনের হয়রানিই করে থাকেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেধাবী শিক্ষার্থী, তার দু একজন শিক্ষক সব সময়ই তাকে নম্বর কম দিয়ে চাপিয়ে রাখতেন। এটা সবার চোখে লাগতো। তারপরেও প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বছরে একই কাজ করছেন। মাঝে মাঝে নাকি বলতেন’ আমি কাউকে পরোয়া করি না। আমি যদি তোমাকে নম্বর না দেই, কোনো ক্লাসও না করি তাতে কারোর কিছু  বলার নেই। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট নয়।’ ঐ শিক্ষার্থী অনার্স শেষ করার আগেই ফ্রান্সের এক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেয়ে যান। তার অনার্স শেষ হয়নি, কয়েকটি কোর্সের পরীক্ষা বাদ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলেছে কোর্সগুলোর রেজাল্ট  জমা দেওয়ার জন্য। কভিড এসে পরায় পরীক্ষা বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বললো তুমি চলে এসো, এখানে এসে অনলাইনে বাকী কোর্সের পরীক্ষা দেবে। ছেলেটি বিভাগের প্রধান, ডিন ও ভিসি পর্যন্ত গিয়ে বহু অনুনয় বিনয় করেও কাউকে বিষয়টি বোঝাতে পারেননি। পরে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন তিনি। মন্ত্রী ভিসিকে যখন ফোন দিয়েছেন, তখন সবাই দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছেন। মন্ত্রী ছেলেটিকে বলেছেন’ তুমি তো দেশের সম্পদ। অনলাইনে পরীক্ষা দেওয়া তো অনেক সহজ। তুমি চলে যাও, ওখানে গিয়ে পরীক্ষা দেবে।’ ছেলেটি ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের সাথে অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেছে এবং বর্তমানে লন্ডন বিম্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন। সবই বৃত্তির মাধ্যমে। অথচ শিক্ষকদের হাতে নম্বর থাকায় তারা ছেলেটিকে কিভাবে চেপে রেখেছিলেন এবং কোন মূল্যায়নই করেননি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যখন এরূপ ঘটে তখন স্কুল ও কলেজ লেভেলে এর ইমপ্লিকেশন কতটা হতে পারে সেটি একটি চিন্তার বিষয়। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যাপক

 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের - dainik shiksha হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস - dainik shiksha নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053489208221436