অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রশিক্ষকদের পেশায় ধরে রাখতে দ্রুত বেতন-ভাতা বাড়ানো উচিত

দৈনিক শিক্ষাডটকম প্রতিবেদক |

অর্থকষ্টে দিন পার করেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষকরা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের।  শিক্ষকতা পেশা বেছে নিলেও অর্থসংকটে শিক্ষা ও গবেষণাবিমুখ তারা। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার মুখে শিক্ষকদের বেতন বাড়ানোর কথা বললেও তা কাজে বাস্তবায়ন করেনি। শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় জনবল ধরে রাখতে দ্রুত বেতন-ভাতা ও সুবিধা বাড়ানো উচিত। দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে ‘পেশা হিসেবে শিক্ষকতার অগ্রগতি’ শিরোনামে শিক্ষকদের বেতন-ভাতার করুণ অবস্থা তুলে ধরা হয়।

রোববার (১ ডিসেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সদস্যরা।

প্রাথমিক শিক্ষকের বেতনে এশিয়ায় ৪৫তম বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয়। এ আইনটি কার্যকর হওয়ার পর সরকার শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতের দায়িত্ব নেয়। প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ জাতীয় বেতন কাঠামোতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা খুব নিচের স্তরে অবস্থান করছেন।

বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ১৩তম গ্রেডে বেতন-ভাতা পান। তাদের মূল বেতন ১১ হাজার টাকা। এর সঙ্গে তারা অবস্থানভেদে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে সর্বমোট ১৯ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন।

গবেষণা বলছে, বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় চার সদস্যের একটি পরিবারের শুধু খাবারের খরচই ২২ হাজার ৬৬৪ টাকা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গড় বেতন ১৭০ ডলার, যা বাংলাদেশের গড় মাসিক মাথাপিছু আয়ের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ কম। উচ্চমূল্যে খাবার কিনে খেয়ে প্রাথমিকের একজন শিক্ষকের পক্ষে সংসার চালানো পাহাড়সম কঠিন।

বিশেষ করে যারা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাদের জন্য এটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক বছর মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের বেতন কাঠামো অনুযায়ী বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতির এ কঠিন সময় পার করছেন তারা।

বেতনের হিসাবে বিশ্বের দেশগুলোর চেয়ে বহু পিছিয়ে বাংলাদেশের প্রাথমিকের শিক্ষকরা। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ৪৫তম। আর দক্ষিণ এশিয়ায় সপ্তম অবস্থানে রয়েছে।

রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা ফারজানা আক্তার। শিক্ষকতা করার প্রবল ইচ্ছা থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন তিনি। তবে আর্থিক অনটনে সিদ্ধান্ত বদলের পথে ফারজানা।

তিনি বলেন, ‘আমার বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব সাড়ে ৮ কিলোমিটার। প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে অটোরিকশা ভাড়া লাগে প্রায় ১০০ টাকা। অর্থাৎ, মাসে যাতায়াত খরচই তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার। ঢাকার বাইরে হওয়ায় বাড়ি ভাড়াও কম। সবমিলিয়ে যে বেতন পাই, তা বলার মতো নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক-স্নাতক শেষ করে শখের বশে প্রাথমিকে চাকরিতে এসে এখন দেখছি জীবন অনেক কঠিন। এ চাকরিতে থেকে বাবা-মায়ের আশা পূরণ সম্ভব নয়। এখন ভিন্ন চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি।’

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে প্রাথমিক শিক্ষকদের করুণ চিত্র তুলে আনায় খুশি ‘প্রাথমিক শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন কমিটি’র সমন্বয়ক মু. মাহবুবর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন যে কথাগুলো বলে আসছি, সেটার কিছু অংশ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে। অথচ আমরা যাদের ওপর ভরসা করে থাকি, তারা বলছেন সহকারী শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া বাস্তবসম্মত নয়। এতে আমরা কষ্ট পেয়েছি। তবে আশাহত নয়। আশা করছি, শিগগির অন্তর্বর্তী সরকার আমাদের দাবি মেনে নিয়ে সহকারী শিক্ষকদের দশম গ্রেড বাস্তবায়ন করবেন।’

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘সহকারী শিক্ষকদের এ দাবি (দশম গ্রেড বাস্তবায়ন) যে যৌক্তিক তা সরকার বরাবর বলে আসছে। কিছু বাস্তবতায় সেটা এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের এ বিষয়টি মাথায় আছে। যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এটা বাস্তবায়ন হবে হয়তো।’

অর্থসংকটে গবেষণাবিমুখ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা

শুধু প্রাথমিক বা মাধ্যমিকের শিক্ষকরাই নয়, বিশ্ববিদালয়ের প্রভাষকরাও অর্থসংকটে ‘জেরবার’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, কম বেতনের কারণে অনেক প্রভাষক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা-গবেষণায় কম সময় দেন। শুধু ক্লাসের সময়টুকু তারা ক্যাম্পাসে আসেন। উৎপাদনমুখী (প্রোডাকটিভ) গবেষণায় তাদের আগ্রহ নেই।

শুধু পদোন্নতির জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা গবেষণা করেন। ফলে অধ্যাপক হওয়ার পর তারা গবেষণা থেকে নিজেকে পুরোপুরি সরিয়ে নেন। যদিও কিছু শিক্ষক প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে গবেষণায় টিকে থাকেন। টিকে থাকাদের অধিকাংশই পারিবারিকভাবে আর্থিক দিয়ে তুলনামূলক স্বচ্ছল।

শ্বেতপত্রে গবেষণার বরাতে উল্লেখ করা হয়েছে, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক পদে চাকরিতে যোগদানের পর একজন শিক্ষক ২২০ থেকে ৪৮২ ডলার সমপরিমাণ বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা পান। তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতে এন্ট্রি-লেভেলের একজন প্রভাষক পান ৭৭০ থেকে ২৪২০ ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। তাছাড়া মালয়েশিয়ায় এন্ট্রি-লেভের প্রভাষকরা ৭০০ থেকে ২৮০০ ডলার এবং সিঙ্গাপুরে ২৯৫০ থেকে ১০৩০০ ডলার বেতন পান। বাংলাদেশ এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে বহু পিছিয়ে। ফলে আর্থিক সংকটে ভুগছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরাও।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে দেড় বছর আগে প্রভাষক পদে যোগ দেওয়া একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘শ্বেতপত্রে কী আছে, তা পড়িনি। তবে আপনি সংক্ষেপে যেটুকু বললেন এটা একটা সামষ্টিক চিত্র। ছোট ছোট সব দিক বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শুনতে যতটা আকাঙ্ক্ষিত মনে হয়, বাস্তবতা তা নয়। বেতনের বাইরে প্রভাষকদের আয় খুব কম। তাছাড়া ঢাকার বাইরে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়, তাদের পার্টটাইম ক্লাস বা অন্য কিছু করার সুযোগ নেই বললেই চলে। এতে শুধুই বেতনের ওপর ভরসা করে চলতে হয়।’

তিনি বলেন, ‘নবম গ্রেডে মূল বেতন ২২ হাজার টাকা। এর সঙ্গে বাসাভাড়া, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা মিলিয়ে ৩৭-৩৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়। বাবা-মা, ছোট বোন ও স্ত্রীর সংসার আমার। পাঁচ সদস্যের সংসারে খাবারের খরচই লাগে ২৫ হাজার টাকা। পোশাকসহ আনুষাঙ্গিক খরচ আছে। সেগুলো খুবই কষ্টসাধ্য। সেখান থেকে অর্থ বাঁচিয়ে গবেষণায় ব্যয় করা সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও গবেষণায় বরাদ্দ খুব কম, বলা যায় নামমাত্র।’

শিক্ষকদের স্বাভাবিক জীবনধারা নিশ্চিত করতে হবে

অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যেখানে মনোযোগ ও ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে হয়। সেজন্য তাদের বেতন দেওয়া কার্পণ্য করা যাবে না। এমনকি বেতন কাঠামোর গ্রেড ও অন্য পেশার সঙ্গে তুলনা করাটাও বাস্তবসম্মত নয়। শিক্ষকদের স্বাভাবিক জীবনধারা নিশ্চিত করলেই কেবল যথাযথ বুদ্ধিবৃত্তিক আউটপুট পাওয়া সম্ভব।

প্রতিবেদনের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীও। তিনি বলেন, ‘পেট ঠিক, তো সব ঠিক। এটা খুব সরল কথা। আবার এটাই খুব কঠিন কথা। স্ত্রী-সন্তান ও নিজের পেট না চললে দেশ-জাতির জন্য ভাবাটা খুব কঠিন। তারপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশের শিক্ষকরা শত প্রতিকূলতার মধ্যেও টিকে আছে।’

তিনি বলেন, ‘জ্যেষ্ঠ অনেক ভালো শিক্ষক এখনো আছেন। তরুণদের মধ্যেও অনেকে খুব ভালো করছেন। তাদের এ ডেডিকেশন দেখে সরকারের উচিত মূল্যায়ন করা। শিক্ষকদের বেতন-ভাতার বিষয়গুলো নিয়ে এ সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে জাতি গঠনে আমরা আরও পিছিয়ে পড়বো।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটির রায় স্থগিত - dainik shiksha ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের ছুটির রায় স্থগিত শ্রেণিকক্ষ এনজিওর কাছে ভাড়া, সেই শিক্ষককে শোকজ - dainik shiksha শ্রেণিকক্ষ এনজিওর কাছে ভাড়া, সেই শিক্ষককে শোকজ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি, সেই আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি, সেই আদেশের কার্যকারিতা স্থগিত সিডি ও নোট-গাইডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে কমিটি - dainik shiksha সিডি ও নোট-গাইডের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে কমিটি অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো উচিত: প্রধান উপদেষ্টা - dainik shiksha অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ানো উচিত: প্রধান উপদেষ্টা স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ: ডিজিটাল লটারি ১২ ডিসেম্বর - dainik shiksha স্কুলে ভর্তি আবেদন শেষ: ডিজিটাল লটারি ১২ ডিসেম্বর ইএফটিতে বেতন: নতুন সময়সূচি এমপিও শিক্ষকদের তথ্য দেয়ার - dainik shiksha ইএফটিতে বেতন: নতুন সময়সূচি এমপিও শিক্ষকদের তথ্য দেয়ার কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025050640106201