আমরা জানি ইউনেসকো জাতিসংঘের বিশেষায়িত একটি এজেন্সি, যা শিক্ষার উন্নয়নে নিবেদিত। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নেতৃত্বের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়নকে তরান্বিত করা, সদস্য দেশগুলোর জাতীয় শিক্ষা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করতে সহায়তা করা, যাতে সব শিক্ষার্থী সুষম শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। সেটাই সংস্থাটির মূল কাজ। এ ছাড়া সংস্থাটি পরিবর্তিত শিক্ষার মাধ্যমে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমুহ মোকাবিলা করতে সহায়তা করে। এভাবেই ইউনেসকো শিক্ষাক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। সংস্থাটি শিক্ষাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে যাচ্ছে। কারণ, শিক্ষা হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকার। শুধু তাই নয় শিক্ষা বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি।
ইউনেসকো-টিচার টাস্কফোর্স শিক্ষকদের ওপর একটি রিপোর্ট পেশ করেছে যা রীতিমতো ভয়ংকর। এই রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা বিশ্ব শিক্ষক স্বল্পতা প্রত্যক্ষ করছে। ফলে এসডিজি-৪ এবং শিক্ষা ২০৩০ এজেন্ডা বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করবে। SDG-4 aims to ensure inclusive and equitable quality education and promote life long learning opportunities for all. আগামী ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পৃথিবীতে ৪৪ মিলিয়ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক স্বল্পতা দেখা দেবে বলে আশঙ্কার করছে। সাব-সাহারান আফ্রিকার দেশগুলোতে আরো ১৫ মিলিয়ন শিক্ষক প্রয়োজন হবে। কারণ, আকর্ষণ না থাকার কারণে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন শিক্ষকেরা। এটি শুধু উন্নয়নশীল বিশ্বেই নয়, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও শিক্ষকেরা পেশা ছাড়ছেন।
বাংলাদেশে আমরা কী দেখলাম? ৯৭ হাজার শিক্ষকের পদ খালি, দেশে বেকারত্ব চরমে অথচ ৯৭ হাজারের বিপরীতে দরখাস্ত করার মতো নিবন্ধিত ও যোগ্য প্রার্থী রয়েছেন মাত্র ২৩ হাজারের মতো। তার মানে আরো কয়েকমাস এই ৭৭ হাজার পদ খালিই থাকবে। পরবর্তী নিবন্ধন পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ অবধি।
ইউনেসকোর রিপোর্ট বলছে শিক্ষক স্বল্পতা মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, প্রয়োজন শিক্ষায় বর্ধিত বিনিয়োগ, শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের রোডম্যাপ তৈরি করা এবং রাষ্ট্রে এমন পলিসি অবলম্বন করতে হবে, যাতে প্রতিটি শিশুকে একজন দক্ষ শিক্ষক, মোটিভেটিভ অর্থাৎ শিক্ষায় প্রকৃত আগ্রহী একজন শিক্ষক পড়াবেন এবং প্রয়োজনীয় সব ধরনের একাডেমিক ও সহ-একাডেমিক কার্যাবলিতে সঠিকমাত্রার সহায়তা দেবেন। রাষ্ট্র যখন এই বিষয়টি নিশ্চিত করবে তখন ভালো শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের ধরে রাখার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেবে।
সব অভিভাবক ভালো শিক্ষকের কাছে তাদের সন্তানদের পড়াতে চান কিন্তু তাদের সন্তান যখন বড় হবে, তাদের সন্তান যদি ভালো ফললাভ করে তবে তারা তাদের অন্য পেশায় যেতে শুধু উৎসাহিত নয় বাধ্য করেন। এ দৃশ্য শুধু বাংলাদেশের নয়, বলা যায় গোটা পৃথিবীর। সব অভিভাবক তাদের সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রশাসক বানাতে চান কিন্তু পড়াতে চান ভালো শিক্ষকের কাছে। তাহলে ভালো শিক্ষক সমাজে আসবে কোথা থেকে? ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভালো শিক্ষক কোথায় পাবে? এই সত্য যখন পরিবার ও রাষ্ট্র উপলব্ধি করতে পারবে তখনই আমরা ভালো শিক্ষক পাবো। শিক্ষকতায় তাদের ধরে রাখার তাগিদ অনুভব করবো।শিক্ষক স্বল্পতা শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি এক ধরনের সংকট। এর ফল অত্যন্ত গভীর ও সুদূরপ্রসারী। শিক্ষক স্বল্পতা মানে হচ্ছে শ্রেণিকক্ষের আকার আরো বড় হওয়া। আর শ্রেণিক্ষকের আকার বড় হওয়া মানে কর্মরত শিক্ষকদের ওপর আরো চাপ বেশি চাপ প্রয়োগ করা। শিক্ষকদের ওপর চাপ শিক্ষাকে আরো নিন্মমূখী করবে। শিক্ষকতা পেশাকে আরো তিক্ত করে তুলবে। শিক্ষায় বৈষম্য আরো বাড়াবে এবং শিক্ষায় অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের চেয়ে ব্যক্তির ও পারিবারিক বিনিয়োগ আরো বেড়ে যাবে। শিক্ষার জন্য আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হাজির হবে।
সর্বশেষ প্রজেকশনে দেখা যায় যে, এসডিজি-৪ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন করতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রয়োজন হবে ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, মাধ্যমিকে প্রয়োজন হবে ১০৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার এবং যৌথভাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে অতিরিক্ত ১২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রয়োজন হবে। এই অর্থ সংস্থান কোথা থেকে হবে? উন্নয়নশীল দেশগুলো বিভিন্ন ধরনের চ্যলেঞ্জের মুখে শিক্ষায় বাজেট কমিয়ে জীবনধারনকারী বিষয়, পরিবেশ রক্ষা, নিরাপত্তা খাতে বাজেট বাড়িয়ে যাচ্ছে।
শিক্ষক স্বল্পতা সমস্যাটি আঞ্চলিক নয়, এটি বৈশ্বিক। উন্নত এবং পরিকল্পিত শিক্ষা কাঠামো থাকার পরেও ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলোতেও মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগ এবং তাদের ধরে রাখতে তারা হিমশিম খাচ্ছে যা শিক্ষার সার্বিক মান বজায় রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিচেছ। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কী অবস্থা? তারা তো উপযুক্ত শিক্ষকই নিয়োগ দিতে পারছে না। যারা শিক্ষকতার উপযুক্ত নয় বাধ্য হয়ে তাদের নিয়োগ দিয়ে যাচেছ। কিন্তু তারাও অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। এভাবে শিক্ষাক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ক্ষতির পরিমাণ ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ ছিলো ৪ দশমিক ৬২ শতাংশ যা বেড়ে বর্তমানে দ্বিগুণ হয়েছে। কারণ, শিক্ষকেরা শিক্ষকতায় প্রবেশের পাঁচ বছরের মধ্যে তাদের পেশা বদল করছেন। এর আর্থ সামাজিক প্রভাব এবং বিস্তৃতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষক স্বল্পতা দূর করার জন্য প্রয়োজন সার্বিক পদক্ষেপ। শুধু ভালো শিক্ষক নিয়োগ করলেই হবে না, নিয়োগের পর তাদের মোটিভেশন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, কাজের পরিবেশ এবং সামাজিক মর্যাদার বিষয়গুলোকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। শিক্ষকতা পেশায় চমৎকার পদসোপান তৈরি করা এবং স্বায়ত্বশাসন নিশ্চিত করা। শিক্ষায় শুধু নারীর নয়, পুরুষের অংশগ্রহণকেও জোর দিতে হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পন্থায় শিক্ষকদের কার্যকরীভাবে যুক্ত করতে হবে। নতুন শিক্ষকদের ধরে রাখার জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, তাদের ধরে রাখার জন্য বিভিন্ন আকর্ষণীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আমরা দেখেছি বাংলাদেশ ব্যাংকের লোভনীয় চাকরিও বহু মেধাবী তরুণ কর্মকর্তাদের ধরে রাখতে পারেনি। কারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের ভূমিকা গৌণ করায় এবং ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রেও তারা ত্রুটি দেখতে পেয়েছেন বলে। এই বিষয়গুলো শিক্ষকতা পেশার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে দেখার সুপারিশ করছে ইউনেসকো। সংস্থাটি বিশেষভাবে এবং আশু সমাধানের জোর দিচ্ছে শিক্ষক যারা পেশা ছেড়ে চলে গেছেন তাদের শূন্যস্থানগুলো দ্রুত পুরণ করার।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক