শিক্ষকরা পেলেনটা কী?

ড. শেখ আবদুস সালাম |

গত ২০ নভেম্বর (২০১৮) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় 'নির্বাচনে সবাই আছেন, শিক্ষকরা নেই'- এই শিরোনামে আমি একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি যেদিন ছাপা হয় তার আগে-পরে আমি কিছুদিন দেশের বাইরে ছিলাম। দেশে ফিরে বেশ কিছু পাঠকের কাছ থেকে অনেক প্রশংসাসূচক মেইল পেয়েছি। গত কয়েক দিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রাতঃভ্রমণকালে দু'একজন শিক্ষক আমার ওই লেখাটি পড়েছেন জানিয়ে মন্তব্য করলেন, স্যার, ভালোই লিখেছেন। কিন্তু শিক্ষকরা আছেন কোথায়, পেলেনটা কী? আমি আমার সহকর্মীর মন্তব্যে এক ধরনের আক্ষেপ ও অভিমানের সুর লক্ষ্য করেছি। আমার সহকর্মীর সেই মন্তব্যকেই শিরোনাম করে আজকের লেখাটি লিখছি।

আমি ওই লেখাটিতে মূলত উল্লেখ করেছিলাম, ১৯৭৩-এর বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার এবং নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন সংক্রান্ত লিগ্যাল রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক RPO (Representation of the People Order)) পরস্পর সাংঘর্ষিক। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তাদেরকে দেওয়া রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় (বিশেষ করে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও জাহাঙ্গীরনগর) আদেশ-১৯৭৩-এ শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনায় স্বাধীনভাবে তা করতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে, বিশেষ করে ওই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইনগতভাবে মূলত এক ধরনের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা ভোগ করে আসছে। এই অর্ডারবলে শিক্ষকরা শুধু শ্রেণিকক্ষে নয়; শ্রেণিকক্ষের বাইরে পাবলিক প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েও তাদের স্বাধীন চিন্তা ও স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার সুযোগ পাচ্ছেন। ওই অর্ডারে প্রদত্ত সুযোগবলে তারা যে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েও কথা বলতে পারেন। এমনকি বৈধ যে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ পর্যন্ত করতে পারেন। 

স্পষ্টই ১৯৭৩-এর অর্ডার দ্বারা পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক ও কর্মকর্তারা চাইলে চাকরিতে থাকা অবস্থাতেই যে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন। এমনকি দলের পোর্টফোলিও পর্যন্ত গ্রহণ করে একজন অ্যাক্টিভিস্টের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারেন। ১৯৭৩-এর অর্ডার অনুযায়ী কোনো শিক্ষক-কর্মকর্তা জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে তাকে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে হবে। এই অর্ডারবলে ঢাকা ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষক অতীতে জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিয়েছেন। কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিতও হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেও বহু শিক্ষক বহুভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগ্রাম এবং দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থেকে দেশের জন্য দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করেছেন। কিন্তু বর্তমান সময়ে এসে দিন দিন রাজনীতির চিত্র অনেকটা পাল্টে যাচ্ছে।

এ পর্যন্ত দেশে ১০টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ বছর ডিসেম্বর মাসে ১১তম সংসদ নির্বাচন। গত ১০টি নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সংসদ সদস্যদের পেশার চিত্র নিলে দেখা যাবে- এখন উকিল, ডাক্তার, শিক্ষক প্রভৃতি পেশার মানুষের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে আকবর আলি খান তার 'জাতীয় সংসদ :পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমরূপ অনুকরণ', 'অবাক বাংলাদেশ বিচিত্র ছলনাজালে রাজনীতি' গ্রন্থে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত সদস্যদের একটি পেশাগত চিত্র তুলে ধরেছেন। পাঠকের উদ্দেশে তা এখানে ছক আকারে তুলে ধরেছি।

আকবর আলি খানের দেওয়া তথ্যমতে দেখা যাচ্ছে, শুধু ব্যবসায়ী ছাড়া আইনজীবী, কৃষিজীবী, শিক্ষক ইত্যাদি শ্রেণি-পেশার মানুষের সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ দিন দিন কমে আসছে। ব্যবসায়ীদের সংখ্যা বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে। জনাব খান অবশ্য আমলাদের চালচিত্র এ ক্ষেত্রে কেমন, তা উল্লেখ করেননি।

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা জোটের হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ছয়জন শিক্ষক আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু তাদের কেউই দলীয় বা জোটগত মনোনয়ন পাননি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মনোনয়নদানের অন্যতম বাধা হচ্ছে RPO (The Representation of the People Order-1972)| 
)। ২০১৩ সালে এই আরপিও সংশোধন করা হয়েছিল মূলত সরকারি চাকরিজীবী, যারা পদে থাকার সময় যথেষ্ট ক্ষমতাবান থাকেন এবং পদ থেকে অবসরে যাওয়া বা চাকরি ত্যাগের পরও তারা ক্ষমতার জোরে ভোটারদের প্রভাবিত করার যোগ্যতা রাখেন এমন ব্যক্তিদের কথা মাথায় রেখে। নির্বাচনে প্রভাব খাটাতে পারেন এমন অবস্থা থেকে মুক্ত থাকতে তাদের ওপর এ ধরনের বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়ে থাকতে পারে। উল্লেখ্য, সরকারি কর্মকর্তারা চাকরিতে থাকাকালে কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারেন না বা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কোনো প্রকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেটা পারেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সংসদ নির্বাচনে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অংশ নিতে পারবেন কি-না, এ ব্যাপারে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত দু'একজন অভিজ্ঞ নির্বাচন কর্মকতার মতামত দেখেছি। তারা বলতে চাইছেন, আরপিও যেহেতু নির্বাচন কমিশনের নির্বাচন সম্পর্কিত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক; কাজেই আরপিওর এই ধারাটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যও প্রযোজ্য। কারণ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও সরকারি কোষাগার থেকে বেতন-ভাতা পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে- তাহলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আলাদা আদেশ-অধ্যাদেশের দরকার কী? আদেশ-অধ্যাদেশ করে শিক্ষকদের একদিকে যে অধিকার দেওয়া হয়েছে, আরপিও বা অন্য কোনো আইন-বিধি প্রণয়ন করে তা খর্ব করা কতটা আইনসিদ্ধ বা ন্যায্য কাজ হয়েছে, তা সংশ্নিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখা দরকার। আমাদের উচ্চ আদালত প্রয়োজনে বিষয়টির ওপর নিজস্ব উদ্যোগে তাদের মতামত রাখতে পারেন।

সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সরকারি কর্মকর্তা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এক পাল্লায় দেখা হলে অন্য সব সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারেও তা এক হওয়া উচিত। প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সরকারি চাকুরেরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের চেয়ে কতটা বেশি সুবিধা ভোগ করেছেন, সে ব্যাপারে ২৯ নভেম্বর (২০১৮) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত 'একের পর এক সুবিধা সরকারি চাকুরেদের' শীর্ষক খবরটি পাঠকবৃন্দ পড়ে দেখতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যখন আয়কর দেন, তখন তাদের আয়কর ধার্য করা হয় তাদের প্রাপ্ত মূল বেতনের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আয়কর ধার্য করা হচ্ছে বেতনের বাইরেও খাতা মূল্যায়ন বা পরীক্ষা পরিচালনা করে তারা যে যৎসামান্য আয় করছেন, তার ওপরেও। সেখানে বলা হচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা এজি অফিস থেকে বেতন পান আর শিক্ষকরা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হিসেবে নিজেরাই তা ড্র করছেন। তাই তাদের মধ্যে চাকরির ন্যাচারের পার্থক্য আছে। এ কারণে শিক্ষকদের জন্য আয়কর প্রদান ভিন্নভাবে প্রয়োগ হবে বা হচ্ছে (!)।

নির্বাচনের ব্যাপারে শিক্ষকদের সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে একই রকম ভাবা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগের ক্ষেত্রে তাদের অন্য কাতারে রেখে দেওয়া হচ্ছে। গাড়ি ক্রয় ঋণ, স্বল্প সুদে বাড়ি তৈরির ঋণ (এ সংক্রান্ত পরিপত্রে বলা হয়েছে, শিক্ষকরা এই ঋণ পাবেন না; তবে পত্রিকায় দেখলাম, এখন বিষয়টি শিক্ষকদের জন্যও ভাবা হচ্ছে), দামি টেলিফোন সেট প্রদান ও সিলিং সুবিধা, ডমেস্টিক এইড সাপোর্ট, পাসপোর্ট সুবিধা এসব ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে শিক্ষকদের আলাদা করে শ্রেণিকরণ করা হচ্ছে। একই মর্যাদাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও সরকারি কর্মচারীদের তুলনায় শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা এবং প্রাপ্তির হিসাবনিকাশে আকাশ-পাতাল ব্যবধান বিদ্যমান। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে, দেওয়া-পাওয়ার সময় শিক্ষকরা সরকারি কর্মকর্তাদের চেয়ে আলাদা। কিন্তু যেখানে আইনগতভাবে শিক্ষকদের চাকরির শর্ত হিসেবে অধিকার দেওয়া হয়েছে, সেখানে আবার অন্য আইন (যেমন আরপিও) দেখিয়ে সেই অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করা হচ্ছে। সে কারণেই আমার সহকর্মীর ওই মন্তব্যই যথার্থ মনে হচ্ছে- স্যার, শিক্ষকরা আছেন কোথায়, পেলেনটা কী?

 


লেখক: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? - dainik shiksha শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের মানদণ্ড কী? প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ - dainik shiksha অবসর-কল্যাণে শিক্ষার্থীদের দেয়া টাকা জমার কড়া তাগিদ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে - dainik shiksha সুপ্রিম কোর্টের ফতোয়ার রায় পাঠ্যপুস্তকে নিতে হবে সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি - dainik shiksha সরকারি কলেজ মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদিমের চাকরি জাতীয়করণ দাবি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030558109283447