দুই যুগ আগে ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল খুলনা মেডিকেল কলেজ। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর আসন বেড়েছে তিন গুণ। কিন্তু শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে অনুমোদিত পদেও নির্দিষ্টসংখ্যক শিক্ষক নেই। ফলে এই কলেজে চিকিৎসাশিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি চলছে জোড়াতালি দিয়ে।
কলেজের শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অভিজ্ঞ চিকিৎসক না থাকার কারণে খুলনা মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছেন না। শিক্ষকসংকটের কারণে ব্যবহারিক, টিউটরিয়াল ও পরীক্ষার সময় অসুবিধা হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পেশাগত পরীক্ষায় পরীক্ষক হতে পারবেন। তবে এই মেডিকেল কলেজের ১৭টি বিষয়ে কোনো অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক নেই।
কলেজ সূত্র জানায়, ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে খুলনা মেডিকেল কলেজের (খুমেক) শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। শুরুতে ৫০ জন শিক্ষার্থীর ভর্তির সুযোগ থাকলেও বর্তমানে প্রতিবছর ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪২। বর্তমানে কলেজের মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৪০। কলেজ কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্যমতে, চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো হলো অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, ফার্মাকোলজি, কমিউনিটি মেডিসিন, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি, বায়োকেমিস্ট্রি ও ফরেনসিক মেডিসিন। বিভাগগুলোয় অনুমোদিত পদের সংখ্যা ৫৮, শিক্ষক আছেন ২৯ জন। শূন্যপদও ২৯টি। মৌলিক বিজ্ঞানের এই আট বিভাগে অধ্যাপকের পদ আছে আটটি। তবে কোনো বিভাগেই অধ্যাপক নেই। একইভাবে এই আট বিভাগে সহযোগী অধ্যাপকের নয়টি পদের সাতটিই শূন্য।
মৌলিক ও অন্য সব বিষয় মিলিয়ে মোট ৩২টি বিষয়ে খুমেকে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকের যথাক্রমে ২৩, ৩৫, ৪৩ ও ৩১টি পদ আছে। এর মধ্যে অধ্যাপক আছেন মাত্র ৬ জন, সহযোগী অধ্যাপকের ২০টি পদ শূন্য, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকের পদ শূন্য ৯ ও ১৪টি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কলেজের একজন প্রভাষক বলেন, একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী কলেজে ঢুকেই যদি দেখেন ক্লাস হচ্ছে না, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নেই, তখন তাঁর আগ্রহ অনেক কমে যায়। আর মৌলিক বিজ্ঞানে ভীত ও দুর্বল হওয়ায় অন্য বিষয়গুলোও তিনি আর ভালোভাবে আয়ত্ত করতে পারেন না। কলেজের অন্তত ছয়জন শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষকসংকটের কারণে তাঁদের নিয়মিত ক্লাস হয় না। এ জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে ব্যবহারিকে ও টিউটরিয়ালে। সঠিকভাবে শিখতে না পারলে ভবিষ্যতে কেমন চিকিৎসা করবেন, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন তাঁরা।
এদিকে গত মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) বরাবর পাঠানো চিঠিতে কলেজের অধ্যক্ষ শিক্ষকসংকটের কারণে প্র্যাকটিক্যাল, টিউটরিয়াল ক্লাসসহ সার্বিক শিক্ষা কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন। সঙ্গে শিক্ষক চেয়ে অ্যানাটমি বিভাগের শিক্ষার্থীদের একটি লিখিত আবেদনও পাঠানো হয়েছে।
কলেজে অ্যানাটমির কোনো অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক নেই। সব মিলিয়ে এই বিভাগে ১০টি পদের ৮টিই শূন্য। একজন মাত্র সহকারী অধ্যাপক ও একজন প্রভাষক আছেন। এই দুজন মিলে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের ২৮৪ জন ছাত্রকে পড়ান।
অ্যানাটমি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রবিউল ইসলাম শাহ বলেন, ‘আমাদের বিভাগে শিক্ষকসংকট এত বেশি প্রকট যে ছাত্রদের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। টিউটরিয়ালে একজন শিক্ষকের বিপরীতে ছাত্র ৭১ জন। টিউটরিয়ালে ছাত্র ২৫ জনের বেশি হওয়া উচিত নয়। ১০ জানুয়ারি থেকে আরেকটা ব্যাচ ক্লাস শুরু করলে সমস্যা আরও তীব্র হবে।’
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মেহেদী নেওয়াজ বলেন, অ্যানাটমি বিষয়ের মাধ্যমে একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর হাতেখড়ি হয়। কিন্তু কলেজে এই বিষয়ে কোনো অধ্যাপক তো নেই-ই, শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষকই নেই এই বিভাগে। অন্যান্য মৌলিক বিষয়েও শিক্ষকসংকট আছে। শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের হাতেখড়িই ঠিকমতো হচ্ছে না। খুলনা মেডিকেল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ চলে মাত্র একজন প্রভাষক দিয়ে। এ কারণে শুধু শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে না, পাশাপাশি আটকা পড়েছে শতাধিক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন। ওই বিভাগের প্রভাষক মো. ওয়াহিদ মাহমুদ বলেন, ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি অস্বাভাবিক কারণে মৃত্যু হলে মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি এবং বিভিন্ন মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার কাজ করতে হয়। কিছু করার নেই। সাতজনের কাজ তাঁকে একাই সামলাতে হচ্ছে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষকসংকটের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার বলা হয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি।