সফল শিক্ষকতা হচ্ছে সর্বাধিক জটিল কর্ম সাধন। একজন শিক্ষকের জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার্থীদের মধ্যে সফলভাবে সঞ্চারিত করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য অনেক যোগ্যতার প্রয়োজন হয়। সেসব যোগ্যতা একই সঙ্গে জন্মগত ও অর্জনীয়। এমন কিছু যোগ্যতা ও দক্ষতা আছে যা প্রশিক্ষণ দিয়েও পূর্ণ করা যায় না। অথচ শিক্ষকতায় সে সব যোগ্যতা ও দক্ষতার আবশ্যকতা অস্বীকার করা যায় না।
বিভিন্ন স্তরে (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে) শিক্ষক নিয়োগের বাছাই প্রক্রিয়ায় অন্যান্য আবশ্যকীয় যোগ্যতাগুলো কোন কর্তৃপক্ষ কীভাবে কতোটুকু মূল্যায়ন করেন তা আমার বিস্তারিত জানা নেই। তবে মাঠের বাস্তবতায় এই মূল্যায়নের ফলাফল সন্তোষজনক বলে মনে হয় না। নিজের যোগ্যতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করার, দীক্ষা দিয়ে শিষ্যে পরিণত করার, গুণের পরশে গুণান্বিত করার, পদ্ধতি দিয়ে পাঠদান করার, প্রেষণা দিয়ে উজ্জীবিত করার, সুশিক্ষা দিয়ে সুযোগ্য করার ও আদর দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শিক্ষকের সংখ্যা আনুপাতিক হারে খুব বেশি নয়।
উত্তম শিক্ষক বাছাই করার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি অন্যান্য যোগ্যতাগুলো যাচাই করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা উত্তম শিক্ষক হবার জন্য উত্তম মেধাবী হওয়ার পাশাপাশি আইসিটিতে ও সহশিক্ষায় পারদর্শী হওয়াসহ আরো অনেক উত্তম গুণের অধিকারী হতে হয়। যার অধিকাংশই যাচাই করা যায় প্রার্থীর সাক্ষাৎকার এবং ডেমো ক্লাসের মাধ্যমে; যদি কর্তৃপক্ষের তেমন সদিচ্ছা ও দক্ষতা থাকে।
যিনি অভ্যাসগত ও স্বভাবগতভাবেই হাসিমাখা মুখে, প্রমিত বাংলায়, স্পষ্ট উচ্চারণে, মধুর কন্ঠে, শুদ্ধ বাক্যে, সরল ভাষায়, উঁচু-নিচু স্বরে, গভীর আন্তরিকতায় সবার সঙ্গে কথা বলেন, তাঁকে শিক্ষার্থীরা অধিক পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। কোনো শিক্ষকের ভাষা অসুন্দর হলে, উচ্চারণ অস্পষ্ট হলে, বাক্য গঠন ভুল হলে, এ্যা অ্যা ও করে কথা বললে, বলার গতি খুব কম/বেশি হলে ও কণ্ঠস্বর অতি নিচু বা বিরক্তিকর হলে শিক্ষার্থীরা সে শিক্ষকের ক্লাসে আগ্রহী থাকেন না, মনোযোগী থাকেন না। তাই সে শিক্ষকের পাঠদান সফল হয় না।
যিনি অত্যন্ত ধৈর্য ধরে কোনো বিষয়বস্তুকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে, আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করে, সহজভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিতে পারেন, তিনি শিক্ষার্থীদের অধিক প্রিয় হবেন, পাঠদানে সর্বাধিক সফল হবেন এটাই বাস্তব। শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরাও তাই বলে থাকেন। শিক্ষার্থীরা যাকে বেশি পছন্দ করেন, ব্যক্তিত্ববান মনে করেন, আইডল মনে করেন, তার নিকট থেকেই বেশি শিখেন। সে শিক্ষাই স্থায়ী হয়।
সরাসরি পাঠদানে মুখের ভাষার প্রভাব সর্বাধিক। তাই শিক্ষকের আঞ্চলিক ভাষা পরিহার ও প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কোনো কিছু সহজে শিশুদের বুঝিয়ে দেয়ার জন্য দু'একটি স্থানীয় শব্দের প্রয়োগ হতে পারে। তবে এনসিটিবি'র বই অনুসারে শিক্ষার্থীদের প্রমিত বাংলা ব্যবহারে অভ্যস্ত বা পাকা করে তোলা শিক্ষকের দায়িত্ব। সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্যই শিক্ষককে প্রমিত বাংলা শুদ্ধভাবে লেখার পাশাপাশি সঠিকভাবে অনর্গল বলায় পারদর্শী হতে হয়।
একাধিক শিক্ষাসনদ অর্জন করেও যিনি কথা বলার সময় আঞ্চলিক ভাষা পরিহার করতে পারেন না তিনি শ্রেণি পাঠদানে প্রমিত বাংলায় কথা বলবেন কীভাবে? আবার যিনি সামান্য অসচেতন হলে ও দ্রুত কথা বলতে গেলে স্থানীয় ভাষা প্রয়োগ করেন তিনিও শ্রেণি পাঠদানে সর্বাবস্থায় প্রমিত বাংলায় কথা বলতে ব্যর্থ হবেন! সেই সাথে ব্যর্থ হবে শিক্ষার্থীরা। কেননা, শিক্ষক হচ্ছেন শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয় অনুসরণীয় রোল মডেল।
একজন মানুষ যতোই মেধাবী হোক, জ্ঞানী হোক, শিক্ষক হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হচ্ছে সেই জ্ঞান শিক্ষার্থীদের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন, বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণ করা। শিখন-শিখানো কার্যক্রম সফল করার জন্য আবশ্যকীয় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য উপাদান হচ্ছে শিক্ষকের সুন্দর ভাষা, উত্তম ব্যবহার, উচ্চ প্রকাশ-ক্ষমতা। শিক্ষকের প্রকাশ-ক্ষমতার উপরই অধিকাংশ নির্ভর করে তাঁর বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান শিক্ষার্থীদের মধ্যে কতোটা সঞ্চারিত হবে। সরাসরি পাঠদানের ক্ষেত্রে যার প্রকাশ-ক্ষমতা যত বেশি তিনি ততো বেশি সফল শিক্ষক। বিশেষ করে মৌখিকভাবে কোনো কিছু সহজে প্রকাশ করার সর্বাধিক ক্ষমতা থাকা চাই শিক্ষকের। সেইসাথে অবশ্যই থাকতে হয় সর্বাধিক মেধা ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। থাকতে হয় আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ব্যবহারের দক্ষতা। হতে হয় ব্যাপক তথ্যসমৃদ্ধ এবং চিন্তা-চেতনায় কর্মে-কথায় অত্যন্ত স্মার্ট। তাই যেকোনো মূল্যে শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করতে হবে সার্বিক বিবেচনায় সর্বাধিক যোগ্যদের।
অন্যান্য পেশার মতো নয় শিক্ষকতা। এটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সৃজনশীল কর্ম। সকল পেশার মানুষ তৈরি করেন শিক্ষক। এজন্যই তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয়। শিক্ষকের যোগ্যতা ও দক্ষতার উপরই নির্ভর করে অন্যান্য পেশার মানুষ কতোটা যোগ্য ও দক্ষ হবেন। একজন অযোগ্য শিক্ষক সারা জীবনে তৈরি করেন অগণিত অযোগ্য নাগরিক। অর্জন করতে ব্যর্থ হন শ্রদ্ধা। ভালো শিক্ষক হবার জন্য যেমন ভালো ছাত্র হতে হয়, তেমনি অন্যান্য যোগ্যতাও থাকতে হয়। বিশেষ কিছু যোগ্যতার দ্বারাই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেন শিক্ষা ও সহশিক্ষার সকল বিষয়বস্তু। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং লিখিত পরীক্ষার পাশাপাশি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ও ডেমো ক্লাসের উপর আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে সার্বিক যোগ্যতার মূল্যায়ন করা অত্যাবশ্যক। সেক্ষেত্রে ট্রান্সপারেন্সি নিশ্চিত করার জন্য অবশ্যই ধারণ ও সংরক্ষণ করতে হবে সেসব সাক্ষাৎকার এবং ডেমো ক্লাসের ভিডিও। স্মার্ট বাংলাদেশে তা সহজেই সম্ভব।
লেখক : মো. রহমত উল্লাহ্, অধ্যক্ষ, কিশলয় বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা